• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

লালমনিরহাটে দয়ালের অকাল মৃত্যু, কাঁদলেন হাজার মানুষ

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১২ জানুয়ারি ২০২০  

‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখর খানি
বেচোনা বেচোনা বন্ধু তোমার চোখের মণি।
...................................................
ঘরদোর বেচো ইচ্ছে হলে, করব নাকো মানা
হাতের কলম জনম দুখী, তাকে বেচোনা।’   

প্রখ্যাত গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী এই গানটির মতোই অসংখ্য কালজয়ী গান ও সংলাপ বাজিয়ে প্রতিদিনই গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, পেশাজীবী, সৃজনশীল সহ সর্বশ্রেণি পেশার লোকজনকে সততায় গড়তে নেপথ্যে নিরবেই কাজ করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পাস দয়াল চন্দ্র রায়। আজ রবিবার সকালে সেই দয়াল চন্দ্র রায় সড়ক দূর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। তার এই অকাল মৃত্যু শোক যেন ছুঁয়ে গেলো হাজার মানুষের হৃদয়। 

নিহতের ছোট ভাই অবিনাশ চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, দয়াল চন্দ্র রায়ের প্রকৃত নাম দয়া রাম (৩০)। পিতার নাম- রমা কান্ত রায়। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বভেলাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তারা তিন ভাই ও দুই বোন।

তিনি বলেন, ‘সংসারের অভাবের কারণে তৃতীয় শ্রেণি পড়া শেষে লালমনিরহাট শহরে চলে আসেন। কিছুদিন স্বর্ণের দোকানে কাজ করতেন। এরপর মাত্র ৩০টা মজুরীতে চায়ের দোকানের কাজ নেন। পরবর্তীতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত মজুরী পেতেন। এই দিয়ে নিজের এবং সংসারের খরচ যোগাতেন। পরবর্তীতে নিজেই স্বপ্ন দেখেন একটি চায়ের দোকান দেবেন। সেই মতে তিনি সাপটানা রোডস্থ এই ছোট্ট টিনশেড ঘরটি ভাড়া নিয়ে ২০১৩ সালে ব্যবসা শুরু করেন। অল্প সময়ে দাদা লালমনিরহাটে সবার মাঝে ‘দয়ালের দায়ের দোকান’ নামেই পরিচিত পান। কোন কিছু করার আগেই তিনি অকালে ঝড়ে গেলেন। তার অকাল মৃত্যু সইবার মতো নয়।’  

রবিবার সকাল ১০টার দিকে এই দয়াল চন্দ্র রায় সড়ক দূর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু বরণ করেন। লালমনিরহাট পৌরসভার সাপটানা রোডস্থ বাজারে বালুবাহী একটি ট্যাফে ট্রাক্টরের চাপায় ঘটনাস্থলেই তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এসময় তিনি নিজের দোকানের জন্য চা পাতা, লং ও ছোট এলাচ কিনে দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন। বালু বোঝাই ট্রাফে ট্রাক্টরটি দয়ালকে পেছন দিক থেকে চাপা দেয়।  

জানা যায়, লালমনিরহাট পৌরসভার সাপটানা রোডের পাশেই কয়েক বছর আগে একটি ছোট্ট টি-স্টল গড়ে তুলেন দয়াল চন্দ্র রায়। সাজানো-গোছানো টিনশেড ছোট্ট একটি টি স্টল। সেখানে নিজ হাতের তৈরি রং চা’র স্বাদে-গুনে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাছাই করা কাস্টমার সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। অল্পদিনে নিজেই হয়ে ওঠেন দয়া রাম রায় থেকে দয়াল চন্দ্র রায়। লালমনিরহাট সদর উপজেলার এমন কোনো এলাকা নেই, যেখান থেকে দয়ালের চায়ের দোকান চিনে না। এক নামে সবাই চিনতেন তার দোকান। 

সাপটানা রোডস্থ দয়াল চন্দ্র রায়ের (দয়া রাম) টিনশেড টি-স্টলটির চারদিকেই ঝুলানো বিখ্যাত মনীষি-রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিকদের ছবি। যেমন-রবীন্দ্র নাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রেকোয়া সাখাওয়াত, জাহানার ইমাম, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অনেকের। ঘরের চার কোণে চারটি মিনি সাউন্ড বক্স। যেখানে মুঠোফোনের সাহায্যে বিখ্যাত গায়কদের বিশেষ বিশেষ গান, কৌতুক, সংলাপ বাজানো হতো। সুস্বাদু রং চায়ের কাপে চুমু দিতে আর প্রিয় গান শোনার জন্যই স্থানীয় কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সর্বশ্রেণি পেশার সৃজনশীল মানুষদের আড্ডায় ভরে থাকত। যেন অসম প্রেমে বন্দী এসব মানুষ চলে আসত দয়ালের জলসায়। রীতিমত ভুপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানের মতোই যেন এটি সেই ‘কফি হাউস!’ হঠাৎই সেই কফি হাউজটি বন্ধ হয়ে গেল! যেখানে আর কখনো বাজবে না সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান গুলো, আসর বসবে না সৃজনশীল মানুষদের আড্ডা। 

দয়াল চন্দ্র রায়ের অকাল মৃত্যুর খবরে শোকে পাথর সেইসব মানুষজন। লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে দয়ালের নিথর মরদেহ দেখে শুভাকাঙ্খিদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে সম্প্রীতির এক নতুন নিদর্শনের চিত্র ফুটে উঠে। জাত বা ধর্ম যেন নেই, একজন মানুষ হিসেবে খ্যাত হয় দয়াল চন্দ্র রায়।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন সরকার দয়াল চন্দ্র রায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে নিজের ফেসবুকে অল্প কথায় লিখেছেন, ‘আমার গল্পের হিরো বড্ড দ্রæত নীল আকাশের তারা হয়ে গেছে। ওপারে ভাল থাকুন প্রার্থনা রইল।’ 

ডেইলী স্টারের লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি এস দিলীপ রায় সদর হাসপাতালে দয়াল চন্দ্র রায়ের নিথর মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি এসময় বলেন, ‘কত স্মৃতি তোমার সাথে। এতো সকালে কেন তুমি এভাবে চলে গেলে। তোমার হাতের তৈরি এক কাপ রং চা না পেলে যে আমার রিপোর্ট হয় না। আজ থেকে কোথায় গিয়ে এই ঠিকানা পাবো।’ 

এ সময় পাশে থাকা প্রথম আলোর প্রতিনিধি ও কবি আবদুর রব সুজন বলেন, ‘সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন, উত্তম রায়, এস দিলীপ রায়, জাহেদুল ইসলাম, মোফাখখারুল ইসলামের একটি ঠিকানা ছিল দয়ালের চায়ের দোকান। সৃজনশীল মানুষরা সেখানে যেতেন চায়ের চুমুকে গান শোনার জন্য। আজ থেকে সেই পথটি রুদ্ধ হয়ে গেলো। একজন ভালো মানুষের অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া যে কত কঠিন, তা আজকে লালমনিরহাটের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার সৃজনশীল মানুষরা টের পেয়েছেন। আমিও তাদের মতোই কষ্ট পেয়েছি।’

তরুণ প্রজন্মের গণমাধ্যম কর্মী ও লালমনিরহাটের নিয়মিত প্রকাশিত সাপ্তাহিক আলোর মনির সম্পাদক মাসুদ রানা রাশেদ তার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যাঁদের দেখা করার জন্য, এক কাপ রং চায়ের লোভে, কালজয়ী গান শোনার জন্যে ছুটে যেতাম দয়ালের চায়ের দোকানে। আজ সেই ছোট ভাই দয়াল চন্দ্র রায় সড়ক দূর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু বরণ করেছেন। এই মৃত্যুটি যেন মেনে নিতে পারছি না।’

সহকারী অধ্যাপক ও লালমনিরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দয়াল চন্দ্র রায়ের মৃত্যুতে নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি ভীষণ মর্মাহত। খুব ভালো ছেলে দয়াল চন্দ্র রায়। ওর আত্মার শান্তি কামনা করছি।’  

লালমনিরহাট সদর থানার ওসি মাহফুজ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘এই খবর পেয়ে দ্রæত ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে দয়ালকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এই ঘটনায় ট্যাফে ট্রাক্টর ও চালককে আটক করা হয়েছে। মামলার প্রক্রিয়া চলছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘দয়াল চন্দ্র রায়ের দোকানটি ছিল বিখ্যাত মনীষিদের ছবির জাদুঘরের মতোই। তাছাড়া কালজয়ী গানের মুর্ছনায় রং চা বিক্রি হতো। শহরের সৃজনশীল, কবি, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও পেশাজীবী লোকজনের আড্ডাস্থল ছিল। আমিও কয়েকদিন গিয়েছিলাম। কিন্তু দয়ালের মৃত্যুতে একটি পরিবারের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটলো। বিষয়টি স্থানীয়দের মারাত্মকভাবে আঘাত দিয়েছে।’
    

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –