• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিশীলিত রাজনীতির পথপ্রদর্শক

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২০ মার্চ ২০২১  

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক 

২০০০ সাল। মো. জিল্লুর রহমান তখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? অক্টোবরের ২০ তারিখে আমার ভৈরবের একটি অনুষ্ঠানে ছেলেরা আপনাকে অতিথি হিসেবে নিতে চায়। আমি নিজেও অনুষ্ঠানে থাকব। আপনি যদি একটু সময় করে আমার ভৈরবে আসতেন, তাহলে আমি অনেক কৃতজ্ঞ হব। আমার ছেলেরাও অনেক খুশি হবে।’ কথা শেষে আমরা যখন উঠব ঠিক সেই সময় তিনি আমাকে বললেন, ‘শোনো সেক্রেটারি, আমি ভৈরবের, ভৈরব আমার, আমি সব সময়ই তোদের প্রগ্রামে যাই। কিন্তু যাদের দাওয়াত করেছিস তাঁরা কিন্তু ভৈরবের মেহমান। খেয়াল রাখিস, তাঁদের যেন কোনো অসম্মান না হয়।’ জিল্লুর রহমানকে যাঁরা চিনেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন তাঁর নম্রতা ও ভদ্রতার কথা। ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেও এমন বিনয়ী আচরণ, অনুজদের প্রতি নির্দেশনার কৌশল বাংলাদেশে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য অনুকরণীয়।

১৯২৯ সালের ৯ মার্চ জন্মগ্রহণকারী মো. জিল্লুর রহমান মাত্র ছয় মাস বয়সে মা এবং ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারান। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফজলুল হক হলের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে সিলেটের গণভোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার সঙ্গের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে মুজিব ভাইয়ের পাশে যাই, উনার পা ছুঁয়ে ছালাম করি, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা ও কথা হবার পর থেকে সক্রিয় রাজনীতির প্রতি আরো আগ্রহ বেড়ে যায় এবং তখন থেকেই মূলত রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে প্রবেশ করি।’ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একমাত্র জিল্লুর রহমানই বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

জিল্লুর রহমান ভাষা আন্দোলনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘২০শে ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের পুকুরপারের যে সভায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে সভার অন্যতম নেতা ছিলেন জিল্লুর রহমান।’ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সনদপত্রও বাতিল করেছিল। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং জয় বাংলা পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সামরিক সরকার বিভিন্ন কারাগারে তাঁকে চার বছর বন্দি রাখে। কিন্তু তাঁর আদর্শ, চেতনা ও রাজনীতিকে বন্দি করতে পারেনি। ১৯৭০ সালে জিল্লুর রহমান সর্বপ্রথম পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এমএনএ নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে মোট পাঁচবার তিনি কুলিয়ারচর-ভৈরব আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদীয় উপনেতা, মন্ত্রীসহ তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদও অলংকৃত করেছেন।

মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সেই সংকটেও তিনি জনগণের রাজনীতি থেকে পিছপা হননি। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর জরুরি অবস্থার মধ্যেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করে সরকার সংস্কারবাদীদের নিয়ে তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে তৎপর হয়। আওয়ামী লীগের অনেক সংস্কারবাদী নেতাকর্মীও তাতে সক্রিয় হন। জাতীয় রাজনীতিতে নেমে আসে নেতৃত্বের শূন্যতা। দলের মধ্যে বিভেদের সুরও প্রতিধ্বনিত হয়। একপ্রকার গৃহবন্দি জিল্লুর রহমানের সামনে একদিকে আপস করে ক্ষমতার বড় পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে আপসহীন থেকে জেলে বন্দিত্বের জীবন বেছে নেওয়ার পথ। কিন্তু তিনি আপস করেননি, আবার তাত্ক্ষণিকভাবে বিদ্রোহও করেননি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দূরদর্শী জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নেত্রী জেলে, এই মুহূর্তে দলাদলি কিসের? নেত্রীকে জেলে রেখে কিসের সংস্কার? তাঁকে ছাড়া দলের কাউন্সিল নিয়ে ভাবি না।’

রাজনীতির দুঃসময়ে আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল থেকে জিল্লুর রহমান অনুজদের আগলে রেখেছেন। দুর্দিনে তাঁর সহনশীল মতামত, নেতা ও নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা, অনুজ নেতৃত্ব-কর্মী ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা, সামাজিক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের কলাকৌশল এবং সহজ-সরল আচরণ রাজনীতির মানুষকে নতুন শিক্ষায় উদ্বেলিত করেছে। জাতির ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারি জিল্লুর রহমান কোনো দল বা জোটের না হয়ে, হয়ে উঠেছিলেন গোটা রাজনীতি পুনরুদ্ধারের বাতিঘর।

রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত অবস্থায় ২০১৩ সালের ২০ মার্চ জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ দল-মত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান এবং শোক কর্মসূচি পালন করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে এটিও একটি অনন্য ঘটনা। জিল্লুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির সব সংস্কৃতিতে বিচরণকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর ৮৪ বছরের বর্ণাট্য জীবনে মানুষের সঙ্গে অসম্মানজনক বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর মূল্যবোধ, শিক্ষা, সামাজিকতা এবং রাজনৈতিক দীক্ষা মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনীতির উজ্জ্বল আদর্শ। যে আদর্শ হতে পারে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের পথপ্রদর্শক। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : প্রাবন্ধিক
[email protected]

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –