• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

কানুনী সুলতান সুলেমান খান

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ নভেম্বর ২০১৮  

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম সাম্রাজ্য, বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো শক্তি অটোমান সাম্রাজ্য তথা উসমানীয় সালতানাত।যাকে এর খ্যাতি, শক্তি ও প্রাচুর্যের চূড়ায় যিনি পৌঁছে দেন, সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে রচনা করেন এক মহিমান্বিত শতাব্দীর তিনি আর কেউ নন সকলের পরিচিত সুলতান সুলেমান।শত জল্পনা, কল্পনার নায়ক, ইতিহাসের কিংবদন্তি পুরুষ, যার কথা অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় তিনিই সুলতান সুলেমান। অনেক উত্থান-পতন,সুখ-দুঃখ ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী তিনি। ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে ত্রাবজান শহরে শাহজাদা প্রথম সেলিমের স্ত্রী হাফসা সুলতানের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ইতিহাসের বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক, সমরনায়ক ও সারাবিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব কানুনী সুলতান সুলেমান খান, মক্কা ও মদীনার রক্ষক, ইসলামের খলিফা।যার নাম আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।যার খ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে পশ্চিমারাই তাকে উপাধি দিয়েছে "সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট"।তার প্রণীত আইন-কানুন ও রীতি-নীতির কাণে আজও সারাবিশ্বের মানুষ তাকে সুলেমান আল কানুনী বলে চেনেন।

 

1.কানুনী সুলতান সুলেমান খান

তুরস্কের মানুষ তাকে ডাকে কানুনী সুলতান ,মুহতেশেম সুলেমান ইত্যাদি উপাধিতে।মাত্র ৭ বছর বয়সেই সুলেমানকে পাঠানো হয় রাজধানী ইস্তানবুলের রাজকীয় প্রাসাদ তোপকাপি প্রাসাদে।সেখানে সে অল্প বয়স থেকেই ইতিহাস,সাহিত্য, তত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা ,ইসলাম, দর্শন ও সমরবিদ্যায় ণৈপুণ্যতা অর্জন করেন।তিনি একইসঙ্গে তুর্কি, আরবি, চাগতাই, ফার্সি ও সার্বিয়ান ভাষায় দক্ষ ছিলেন।এখানেই তিনি তার বাল্যবন্ধু ও সঙ্গী পারগালির সঙ্গে পরিচিত হন।যিনি ইতিহাসে পারগালি ইব্রাহিম পাশা নামে বেশি পরিচিত। শাহজাদা হিসেবে সুলেমানের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক দায়িত্বের জীবন শুরু হয় ১৭ বছর বয়সে।এসময় তাকে প্রথমে কাফফার গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয়।পরবর্তীতে মানিসা ও এড্রিনেও তিনি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন।১৫২০ সালে পিতা ইয়াভুজ সুলতান সেলিমের মৃত্যুর পর ইস্তানবুলে উসমানী সালতানাত বা অটোমান সাম্রাজ্যের ১০ম সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন সুলতান সুলেমান খান।তৎকালীন এক ভেনেটিয়ান দূত বার্তোলোমিও কোন্তারিনির মুখ থেকে তার বিবরণ পাওয়া যায় এমন যে," সুলতান ছিলেন মাত্র ২৫ বছরের যুবক।লম্বা দেহ, চওড়া কাঁধ ও চিকন চেহারা বিশিষ্ট।সুলতানের ব্যবহার ছিল বন্ধুসুলভ,কোমল ও পরিমার্জিত।সুলতান বই পড়তে পছন্দ করতেন, তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ও সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পছন্দ করতেন।

সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের পরপরই চারদিক দিয়ে যুদ্ধের হুংকার আসতে থাকে সালতানাতের দিকে।অসীম মেধা ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি এক একটি যুদ্ধ জয় করেন এবং ইউরোপ থেকে এশিয়া সর্বত্র তিনি উসমানী সালতানের প্রভাব বিস্তার করেন।তার যুদ্ধ যাত্রা শুরু হয় ১৫২১ সালে সিরিয়ার দামেস্কে নিযুক্ত বিদ্রোহী গভর্নরের বিরুদ্ধে।তাকে পরাজিত করেই সুলতান নজর দেন কিংডম অব হাংগেরির দিকে।সার্ব, ক্রোয়েট ইত্যাদি রাজ্যের পতনের পরে একমাত্র হাংগেরিয়ানরাই ছিল ইউরোপে ক্ষমতা বিস্তারে অটোমানদের পথের কাটা।হাংগেরির রাজধানী বেলগ্রেড ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর,যা সুলতান সুলেমানের প্রো-পিতামহ সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।১৫২১ সালের আগস্ট মাসে তিনি বেলগ্রেড অবরোধ করেন।কয়েক সপ্তাহ তীব্র গোলাবর্ষণের পর বেলগ্রেডের পতন হয়।বেলগ্রেডের পতনে ইউরোপব্যাপী খ্রিষ্টান রাজ্যসমূহে ভয়ের সঞ্চার করে।বলা হয়ে থাকে এ সংবাদ শুনে হাংগেরীর রাজা লুইস মারা যান।এরপর সুলতান সুলেমান ভূমধ্যসাগরে অভিযান পরিচালনা করেন।মাল্টা ও রোডস দ্বীপপুঞ্জে তখন ছিল খ্রিষ্টান ক্রুসেডার নাইটস হস্পিটলারদের শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে তারা বিভিন্নসময় মুসলিম ব্যবসায়িক জাহাজে হামলা ও লুটতরাজ করত।সুলতান সুলেমান এদেরকে দমনের জন্য ৪০০ টি রণতরীর এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন।অপরদিকে তিনি নিজে ১ লাখ ৮০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনর উপকূল দিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন।১৫২২ সালের গ্রীষ্মে তিনি রোডস দ্বীপ অবরোধ করেন পরবর্তী মাসব্যাপী তীব্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দ্বীপটি দখল করেন।তিনি এসময় আটক খ্রিষ্টানদের মুক্তি দেন ও তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

 

3.কানুনী সুলতান সুলেমান খান

১৫২৬ সালে মোহাকসের যুদ্ধে তিনি আবারো হাংগেরিয়ানদের পরাজিত করেন।এ যুদ্ধে হাংগেরিয়ান রাজা দ্বিতীয় লুইস মৃত্যুবরণ করেন।একে একে তিনি তৎকালীন সকল পরাশক্তিসমূহকে পরাজিত করেন।ইউরোপের শক্তিশালী হাবসবুর্গ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে পারস্যের প্রতাপশালী সাফাভিদ শাহ সকলেই তার কাছে পরাজিত হয়।শুধু সেনাবিহিনীই নয় তার আমলে শ্রেষ্ঠ উসমানীয় নৌসেনাপতি কাপুদান পাশা হিজির হায়রেদ্দীন বারবারোসার নেতৃত্বে নৌশক্তিতেও উসমানীয়রা প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে উঠে। ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর, লোহিত সাগর সর্বত্র তাদের সগর্ব বিচরণ ছিল।এমনকি ভারতীয় উপমহাসাগরে ইন্দোনেশিয়ার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলোকে ডাচদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি অভিযান পাঠান সুলতান সুলেমান।

সুলতান সুলেমান একদিকে যেমন যুদ্ধ জয় করেছেন অন্যদিকে তিনি রাজ্যের মানুষের শান্তি ও উপকারের জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক উন্নতি ও পরিবর্তন করেন।সঠিক ন্যায়বিচার ও আইন প্রণয়নের জন্য সাধারণ মানুষ তাকে কানুনী সুলতান উপাধি দেয়।ইসলামের শরিয়াহ আইনকে ঠিক রেখে জনগণ ও প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জন্য ন্যায়বিচার করার লক্ষ্যে ও সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তিনি প্রধান মুফতি আবুসসুদ এর সহায়তায় সুলেমান লিগ্যাল কোড বা আইন নীতি প্রণয়ন করেন যার মূলে ছিলো ইসলামিক আইন।যাকে কানুন-ই-উসমানী নামেও ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে।তিনি রাজ্যের খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দেন।খাজনা বা ট্যাক্স ব্যবস্থার উন্নতি ও পরিবর্তন করে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করেন অন্যদিকে জনগণের জীবন মান উন্নয়ন করেন।তিনি ইউরোপের রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা নির্যাতিত অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের আশ্রয় দেন।সুলতান অপরাধের ভিন্নতা ও মাত্রার উপর ভিত্তি করে জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তির ব্যবস্থা করেন ।

 

5.কানুনী সুলতান সুলেমান খান

সুলতান সুলেমানের শাসনামলে উসমানী সালতানাত শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় এক সোনালী যুগে প্রবেশ করে।তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী মানুষ।তিনি দেশব্যাপী সকল মসজিদে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন।রাজধানী ইস্তানবুল ও আশেপাশে প্রচুর মক্তব ও মাদ্রাসা তৈরী করেন যেখানে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা হয়।যা উক্ত সময়ে ইউরোপের কোনো দেশে করা প্রায় অসম্ভব ছিল।এছাড়া শিল্পচর্চার দিক দিয়েও তিনি অনেক সচেতন ছিলেন।তার আমলে প্রায় ৬০০ জনের অধিক শিল্পী ও কলাকুশলী রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কাজ করতেন।সুলতান নিজেও একজন কবি ছিলেন।তিনি ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন।যার মধ্যে অন্যতম "মুহিব্বি"।তার আমলে ইউরোপীয়,তুর্কি,আরবী ও ফার্সি কালচারের এক অনন্য মিশ্রণ সৃষ্টি হয়।তার সময়ে স্থাপত্যকলায়ও ব্যাপক এগিয়ে যায় উসমানীয়রা।বিখ্যাত নির্মাণ ও স্থাপত্য শিল্পী মিমার সিনান এসময় দৃষ্টিনন্দন ও চমকপ্রদ স্থাপত্যকলা দিয়ে তৈরি করেন সুলায়মানীয়া মসজিদ,সেলিমিয়া মসজিদ ইত্যাদি যা আজও তুরস্কের সৌন্দর্য বর্ধণ ও ইতিহাসের সোনালী যুগের সাক্ষ্য বহন করছে।পাশাপাশি তিনি কাবার সংষ্কার, মক্কা-মদিনার যোগাযোগ উন্নয়ন ইত্যাদি বহুবিধ কাজ করেন।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –