• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

কলকাতা: বেকার হোস্টেল: বঙ্গবন্ধু

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২০  

অমিত গোস্বামী

বঙ্গবন্ধু কলকাতায় কোথায় কোথায় থেকেছেন বা সময় কাটিয়েছেন তা অনেকেরই আজও অজানা। বঙ্গবন্ধু ছাত্র জীবনে কলকাতায় বেকার হস্টেলসহ চারটি জায়গায় থেকেছেন। প্রথম জায়গা তার বড়বোন আসিয়া খাতুন ও শেখ নুরুল হকের পার্ক-সার্কাসের বাসা বাড়ি। সেটা সম্ভবত ছিল বর্তমান চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের পাশের গলিতে, দ্বিতীয় জায়গা তালতলার ৮ নং স্মিথ লেনের বেকার হোস্টেল, তৃতীয় জায়গা ২ ও ৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট যা ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের অফিস এবং হাওড়ার উল্টোডাঙায় বন্ধু শেখ শাহাদাত হোসেনের বাসা। বঙ্গবন্ধু তার কিশোর বয়সে বেশ কয়েকবার কলকাতায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য।

আসিয়া খাতুন ও শেখ নুরুল হকের পার্ক-সার্কাসের বাসা বাড়ি:- শেখ আসিয়া খাতুন শেখ লুৎফর রহমানের দ্বিতীয় সন্তান। মুজিবের থেকে ঠিক দুবছরের বড়। মা সায়েরা খাতুন শেখ আসিয়া খাতুনকে বিয়ে দেন পাশের বাড়ির শেখ নুরুল হকের সাথে- যাতে মেয়েকে চোখের সামনে সবসময় দেখতে পান। শেখ নুরুল হক সরকারি চাকরি নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। বাসা ভাড়া নেন পার্ক-সার্কাস অঞ্চলে। শেখ লুৎফর রহমান টুঙ্গিপাড়া থেকে ১৭ মাইল দূরে গোপালগঞ্জ শহরে তার ১৪ বছরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ভাড়াবাসায় থাকেন। স্ত্রী সায়েরা খাতুন গ্রামের বাড়িতে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকেন। সালটা ১৯৩৪। এই মুজিবুর চূড়ান্ত দস্যি ছেলে। সারা গ্রাম তার দৌরাত্মে অস্থির। কী খেলাধুলায়, কী গানবাজনায় বা ব্রতচারীতে সে একাই একশ’। কিন্তু হঠাৎ সে মিইয়ে গেল। তার শরীরে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল ঝিমডুবুনি রোগ। সবসময় ঝিমোচ্ছে। গ্রামের ডাক্তার মইনুল চাচা তার আব্বাকে বললেন – লুৎফর, আমি ভাল বুঝছি না। মনে হচ্ছে বেরিবেরি। তুমি কলকাতায় নিয়া যাও। ওখানে শিবপদ ডাক্তারবাবুকে দেখাও। সেই প্রথম শেখ মুজিব কলকাতায় এলেন চিকিৎসার জন্য। ছিলেন একমাসের কিছু বেশী। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য ও ডাক্তার এ কে রায়চৌধুরীর চিকিৎসায় দ্রুত সুস্থ হলেন তিনি।

এরপরে আব্বা বদলি হয়ে এলেন মাদারীপুরে। এখানকার আদালতের সেরেস্তাদার। ধীরে ধীরে শরীর সেরেছে। সেই জন্যে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে। আবার নতুন করে পড়াশুনো তিনি শুরু করেছিলেন। ভালই এগোচ্ছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ চোখে বেশ সমস্যা শুরু হল। মাদারীপুরের ডাক্তার বললেন - মনে হচ্ছে গ্লুকোমা। যত শিগগিরই সম্ভব কলকাতায় নিয়ে যান। ১৯৩৬ সাল। এ ব্যাপারে গাফিলতি চলে না। তিনি পরের দিনই মুজিবকে নিয়ে রওনা হলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। স্টিমার ও বরিশাল এক্সপ্রেসের যাত্রার শেষে স্ত্রী সায়েরা খাতুন ও মুজিবকে নিয়ে লুৎফরের ভাড়া করা ঘোড়াগাড়ি যখন কন্যা আসিয়া ও জামাই নুরুলের বাসায় হাজির হলেন তারা। কলকাতা মেডিকেল কলেজে চক্ষুবিভাগের প্রধান ডাঃ টি আহমেদ তার অপারেশন করলেন। অপারেশনের পরে ডাক্তার আহমেদ বেশ খুশির গলায় বললেন “দৃষ্টিশক্তি ঠিকই থাকবে। তবে চশমা পড়তে হবে ওকে (শেখ মুজিব)। লেখাপড়ায় সমস্যা হবে না। ‌ঠিক দশদিন পরে ডান চোখেরও অপারেশন হল একই পদ্ধতিতে। হাসপাতাল থেকে ১৫ দিন পরে সম্পূর্ণ সুস্থ করে মুজিবকে ছুটি দেয়া হল। সঙ্গে তার জুটে গেল চশমা। নতুন বছর পড়তেই ডাক্তারের অনুমতি মিলল আবার নতুন করে পড়াশুনো শুরু করার। শেখ মুজিব তার আব্বার কাছে ইচ্ছা পেশ করলেন পুরোনো স্কুলে পড়বেন না। সেখানে সহপাঠিরা সব এগিয়ে গেছে।

এরইমধ্যে শেখ লুৎফর রহমান বদলি হয়ে ফিরে এলেন গোপালগঞ্জে। মুজিবকে ভর্তি করে দিলেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। সেখানে ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি পরিদর্শনে এলেন বাংলার প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সেখানেই শেখ মুজিবের সাথে নৈকট্য ঘটল শহীদ সাহেবের। তারপরে মুজিব কলকাতায় আসতে শুরু করেন প্রায়শই। ‘অসামাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু বলছেন - ‘পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা–সমাবেশে যোগদান করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) কাছে এখন প্রায়ই যাই।‘ এই সময়ে তিনি নিয়মিত থেকেছেন পার্ক সার্কাস অঞ্চলের বড়বোন আসিয়া খাতুন ও শেখ নুরুল হকের বাসায়। এরপরে ১৯৪২ সালের শুরুতেই এনট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে তার কলকাতায় পড়তে আসা। ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। ওয়েলেসলি স্ট্রিটের এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৬ সালে। দ্রুত কলেজে মুজিব হয়ে উঠলেন পরিচিত মুখ। তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর থিয়েটার রোডের বাড়িতে। কলকাতার থিয়েটার রোড বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণীর তার বাসভবন অনেকে আগেই চলে গেছে ভূমিদস্যুদের কবলে। এখন সেখানে বহুতল বাড়ি।
 
তালতলার ৮ নং স্মিথ লেনের বেকার হোস্টেল:- রাজনৈতিক সংপৃক্ততার কারণে শেখ মুজিবের পক্ষে আর বোন আসিয়া খাতুনের বাসায় বেশিদিন থাকা সম্ভব হল না। ১৯৪৩ সালের শেষভাগে তিনি চলে এলেন বেকার হোস্টেলে। ছাত্রাবাসটি ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১০ সালে এডওয়ার্ড নরম্যান বেকার প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার ৮ স্মিথ লেনে অবস্থিত। কলকাতায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য ১৮৯৬ সালে নির্মিত টেইলর হোস্টেলের চারপাশের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অপর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থার কারণে ১৯০৮ সালে নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য আন্দোলন হয়। এর ফলে কলকাতায় বেকার হোস্টেল নির্মিত হয়। এই হোস্টেলের সুপার ছিলেন অধ্যাপক সাইদুর রহমান। তাকে (বঙ্গবন্ধু) বরাদ্দ করা হল তৃতীয় তলার ২৪ নং কক্ষটি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি লক্ষ্য করলেন যে মুজিবের নিজের রুমে অর্থাৎ ২৪ নং ঘরে সবসময় কোন না কোন গেস্ট থাকেন। মুজিবকে প্রিন্সিপাল জুবেরী সাহেব ও সুপার সাইদুর রহমান সাহেব খুবই স্নেহ করতেন। মুজিব ছাত্রদের বিপদে আপদে সাহায্য করেন। কার হোস্টেলে সিট প্রয়োজন, কার ফ্রি সিট দরকার – সব ব্যাপারে মুজিবের কথাই চূড়ান্ত। অধ্যাপকরা জানেন যে মুজিব কখনো অন্যায় আবদার করেন না। কিন্তু তার কাছে এই অতিথি আসার ঢল তাদের চিন্তিত করে তুলল। কারন মুজিবের রুম সিট না পাওয়া পর্যন্ত অনেকেরই ফ্রি রুম। এই কারণে মুজিবের পড়াশুনোর খুব ক্ষতি হচ্ছে। সুপার অধ্যাপক সাইদুর রহমান তাকে পড়াশুনার জন্যে ২৩ নং ঘরটি বরাদ্দ করে দিলেন। তিনি কঠোর নির্দেশ দিলেন যে ২৩ নং ঘরে মুজিব পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন। কেউ যেন বিরক্ত না করে। কিন্তু কীসের কি! মুজিব তখন ব্যস্ত মুসলিম লীগের ‘পাকিস্তান’ আন্দোলন নিয়ে।
 

২ ও ৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট- বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের অফিস:-  আই এ পরীক্ষার পরে বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফিরে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিনের কাছে খবর পেলেন যে তাদের দিল্লি যেতে হবে ডেলিগেট হিসেবে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন’-এ। এটা অবশ্যই বিরাট সম্মান। ১৯৪৫ সালে তিনি হল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য। এই ঘটনাবহুল সময়ে তার দিনের বড় অংশ এবং অনেক রাত কেটে যেত প্রাদেশিক মুসলিম লিগের অফিসে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুমতিক্রমে ১৯৪৬ এ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হল মুসলিম লীগের বক্তব্য উল্লেখের জন্যে পত্রিকা ‘মিল্লাত;। সম্পাদক আবুল হাশিম সাহেব। মুসলিম লীগ অফিসের একতলায় কয়েকটা খালি রুমে যন্ত্রপাতি বসল। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ও শেখ মুজিবুর রহমান লেখা সংগ্রহ, গ্রাহক সংগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাদের রাতের পর রাত কাটত এই অফিসে।
 

হাওড়ার উল্টোডাঙায় বন্ধু শেখ শাহাদাত হোসেনের বাসা:- ১৯৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গার পরে নোয়াখালী ও বিহারে দাঙ্গা হল। দাঙ্গাবিধ্বস্ত উদ্বাস্তুদের জন্যে আসালসোলে তৈরি হল ক্যাম্প। তার দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। ক্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে প্রায় জোর করে কলকাতায় নিয়ে এলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কন্যা বেগম সোলায়মান। আসানসোল থেকে অসুস্থ মুজিব কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ফিরে আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তুমুল জ্বর। শহীদ সাহেব দ্রুত ট্রপিকাল স্কুল অফ মেডিসিনের ইউরোপীয় ওয়ার্ডে মুজিবকে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। পনের দিন থাকলে হল হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে হোস্টেলে ফিরে মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই স্বল্প সময়ে পড়াশোনা করে হলেও পরীক্ষাটা তিনি দেবেন। প্রিন্সিপাল জুবেরীকে জানালেন তার অভিপ্রায়। ক্লাসে হাজিরা তো প্রায় নেই। প্রিন্সিপাল জুবেরী বললেন “তুমি পাকিস্তান অর্জনের জন্যে যথেষ্ঠ কাজ করেছ। আমি তোমায় বাধা দেব না। কিন্তু তোমায় ওয়াদা করতে হবে যে তুমি এই ক’মাস পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করবে। হোস্টেল ছেড়ে কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবে যেখানে তোমার পড়া ছাড়া কোন কাজ থাকবে না। পরীক্ষার আগে এসে শুধু পরীক্ষা দেবে। এই শর্তে রাজী থাকলে আমি অনুমতি দেব।

“ মুজিব ওয়াদা করলেন অন্যান্য অধ্যাপকদের সামনে। এরপরে হোস্টেল ছেড়ে তিনি সোজা গিয়ে উঠলেন হাওড়ায় বন্ধু শেখ শাহাদাত হোসেনের বাসায় সমস্ত বইপত্র নিয়ে। সেখানে কয়েকমাসের অজ্ঞাতবাসের পরে পরীক্ষার ঠিক আগে ছোট বোনের বাসা পার্ক সার্কাসে এসে উঠলেন। বসলেন বি এ পরীক্ষায়। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
 
এর বাইরে শেখ মুজিবের যাতায়াত ছিল ছোটবোনের বাসা হুগলীর শ্রীরামপুরে। সেখানে মুজিবের ছোটভাই শেখ আবু নাসের ১৯৪৬ এ এসে উঠেছিলেন। এর বাইরে তিনি কোথাও কিছুকাল কাটিয়েছেন বলে জানা যায় না। তবে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসে সবাই বেকার হোস্টেলেই যান কারণ সেটি আজও একইরকম ভাবে টিঁকে আছে। আমি ‘মহানির্মাণ’ উপন্যাস লেখার সময় বঙ্গবন্ধুর কলকাতার বিভিন্ন বাসস্থানের খোঁজ করতে গিয়ে এই চারটি জায়গার খোঁজ পেয়েছি। শেষের জায়গাটি হাওড়ার ঠিক কোথায় ছিল তা নির্দিষ্ট করতে পারিনি। বড়বোন আসিয়া খাতুন ও শেখ নুরুল হকের পার্ক-সার্কাসের বাসা বাড়ি সম্পর্কে ভাসাভাসা তথ্য পেয়েছিলাম দু’একটি স্মৃতিকথায়। কিন্তু এ নিয়ে যে দীর্ঘ গবেষণা প্রয়োজন তা করতে পারিনি। তার কারণ বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবন নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার আর্থিক কোন পৃষ্ঠপোষকতা আমার ছিল না। সে কারণে আমি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবনের গল্প সবাইকে বলতে চেয়েছি উপন্যাসের মাধ্যমে। মনে রাখবেন ঔপন্যাসিকের তথ্য-প্রমাণের দায় থাকে না। তবে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন আছে। তার রাজনৈতিক জীবনের মহানির্মাণ হয়েছিল এই কলকাতায়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, কলকাতা।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –