• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ের বড় অংশ যাচ্ছে ওষুধে

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২৪  

স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ের বড় অংশই যাচ্ছে ওষুধে। বছরে ওষুধের পেছনে ব্যয়ের ৯৪ শতাংশই আসে পরিবার থেকে। বিষয়টি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউএইচসি) অর্জনের মাইলফলক বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়তে হলে ওষুধে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন জরুরি বলে মন্তব্য করছেন তারা।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

তারা বলছে, বছরে ওষুধের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থের সংস্থান আসে মূলত চার উৎস থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবারের। ওষুধের মোট ব্যয়ের ৯৪ শতাংশ পরিবারগুলো নিজস্ব আয় থেকে করছে। সরকার করছে ৬ শতাংশ, উন্নয়ন সহযোগীর মাধ্যমে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা করছে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের শেষে প্রকাশিত এ তথ্য মূলত ২০২০ সালের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে তুলে ধরা হয়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে। ঐ বছরের সরকারি তথ্য ২০২১ সালে হাতে পায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বেসরকারি তথ্য নেয় ২০২২ সালে। গত বছর প্রকাশ করা হয় ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ওষুধের স্থানীয় বাজার ছিল ৩৮ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকার ওষুধ যাচ্ছে ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি থেকে, যা শতকরা ৮৬ শতাংশ। আর সাধারণ হাসপাতালে ব্যয় হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকা বা ৪ শতাংশ, বিশেষায়িত হাসপাতাল ব্যয় করছে ১ হাজার ১০০ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বহির্বিভাগে পৌনে ৮০০ কোটি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনায় ওষুধের ব্যয় সোয়া ১ হাজার কোটি এবং প্রতিরোধমূলক সেবার জন্য ব্যয় হচ্ছে ৪০ কোটি টাকা।

সরকারের ঐ গবেষণায় কাজ করেছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট ও ইউনির্ভার্সাল হেলথ কাভারেজের ফোকাল পয়েন্ট ডা. সুব্রত পাল।

তিনি বলেন, ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টে আমরা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খরচগুলো দেখিয়েছি। সেখানে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার এবং ওষুধের ব্যয়ও দেখানো হয়েছিল। তবে ওষুধের ব্যয়গুলোর অর্থায়ন কীভাবে কোন উৎস থেকে হয়েছে তা পরে এ পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আমাদের দেশে মানুষ শতকরা ৬৮ টাকার বেশি ব্যয় করছে নিজের পকেট থেকে। সেখানে ওষুধের খরচ সর্বোচ্চ। আর বছরে ওষুধে যে ব্যয় হচ্ছে তার ৯৪ শতাংশ আসছে পরিবার থেকে।

দেশে স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ ব্যয় হয় তার প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে ওষুধে। গত কয়েক দশকে এ ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বর্তমানে এ ব্যয়ের হার ৪৪ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে ওষুধের খরচে বৈশ্বিক গড় ব্যয় ১৫ শতাংশ। সবশেষ ২০২০ সালের হিসাবে দেখা যায়, সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সংস্থার বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয়ে ৭৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ওষুধে ব্যয় হয়েছে ৪৪ শতাংশ। এছাড়া ২৩ শতাংশ হাসপাতাল অবকাঠামো, বহির্বিভাগে চিকিৎসায় ব্যয় ১৬ শতাংশ, পরীক্ষায় ৮ শতাংশ, জনস্বাস্থ্যমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৪ শতাংশ, প্রশাসনিক কার্যক্রমে ২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে খরচ হয়েছে ২ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার বা সরকারি খরচের বাইরে ব্যক্তি যে ব্যয় করে) বেড়েছে। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে ১০০ টাকায় ২০১৫ সালে ব্যক্তির খরচ ছিল ৬৭ টাকা। ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৬৯ টাকায়। আর স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় ২০১৭ সালে ২৬ শতাংশ ছিল, তা ২০২০ সালে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। 

স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতে সরকার, দাতা সংস্থা ও বেসরকারি ব্যয়বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা করে সংস্থাটি সরকারকে পরামর্শ দেয়। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ব্যক্তির বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে খরচ হচ্ছে ১০ শতাংশ, বহির্বিভাগে (বেসরকারি চেম্বার) ব্যয় হচ্ছে ১৩ শতাংশ, রোগ নিরীক্ষায় ১২ শতাংশ এবং বাকি ব্যয় হচ্ছে পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় দিনদিন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার (ওপিই) বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বড় অংশ যাচ্ছে ওষুধে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ওপিই ৭৪ শতাংশ। বিষয়টি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। ওপিই কমাতে হলে ওষুধের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই কমাতে হবে। সরকারকে ওষুধের ব্যয়ে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। যখন সরকার ব্যয় বাড়াবে তখন স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য বীমার প্রয়োজন হবে। কেননা বীমা ছাড়া এ অর্থায়ন কঠিন। আর বীমার আওতায় অর্থায়ন করলে স্বাভাবিকভাবেই ওষুধে ব্যয় কমে যাবে। এখানে দুটি বিষয় রয়েছে, তাহলো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন কমানোর সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকে সরকারের পক্ষ থেকে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিন অনুষদে ডিন ও পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক বলেন, দেশের ওষুধের বাজারের ৯৪ শতাংশই নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। অর্থাৎ নিজের টাকায় মানুষ এসব ওষুধ কিনছে। বিষয়টি কমাতে হলে প্রয়োজন স্বাস্থ্য বীমা। সাংস্কৃতিক অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে ওষুধের দিক থেকে মানুষকে বের করে আনতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ গ্রহণের দিকে যাওয়া যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেভাবে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ হচ্ছে তাতে ওষুধের ব্যয় কমানো কঠিন।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –