• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ঠাকুরগাঁওয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক সৈয়দ আলী স্যার

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২১  

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল একজন ব্যবসায়ী হবেন। কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে এতই সখ্য ছিল যে অন্য সব স্বপ্ন বাদ দিয়ে হলেন শিক্ষক। ছাত্রজীবনে যেমন শিক্ষকদের ছিলেন প্রিয় ছাত্র, তেমনি শিক্ষকজীবনে সব শিক্ষার্থীর কাছেও হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রিয় শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিলেও আজও সবার মনে জায়গা করে আছেন সবার প্রিয় শিক্ষক অধ্যক্ষ সৈয়দ আলী।

ঠাকুরগাঁও শহরের দক্ষিণ ঠাকুরগাঁও এলাকার বাসিন্দা ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সৈয়দ আলীর হাত দিয়ে তৈরি হয়েছেন হাজারো শিক্ষার্থী, যারা আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এই প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে, একান্ত সাক্ষাৎকারে।

জানা যায়, প্রথমে গ্রামের একটি বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শুরু করেন শিক্ষক সৈয়দ আলী। এরপর ১৯৬৭ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর দিনাজপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৭২ সালে এন্ট্রান্স পাস করে ৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে ১৯৭৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে বাসায় ফিরে আসেন তিনি। দীর্ঘদিন বাসায় বসে থাকলেও ছিল না চাকরির করার ইচ্ছা।

এরপর ১৯৮১ সালে প্রথম তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন যশোর এমএম কলেজ থেকে। সেখানে তিনি দর্শন বিষয়ে পড়ানো ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো শুরু করেন। পরে দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজ, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, দিনাজপুর ফুলবাড়ি সরকারি কলেজ, ঢাকা ইডেন কলেজ এবং ২০০৮ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে, ২০০৯ সালে সিরাজগঞ্জ ইসলামি সরকারি কলেজ, সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ২০১৫ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি।

একজন ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, শিক্ষক সৈয়দ আলী বলেন, মা-বাবার সঙ্গে একজন সন্তানের যে সম্পর্ক, একজন শিক্ষকের সঙ্গে সেই সম্পর্ক হতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তান ভেবেই তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। আমি যেমন সব সময় অন্য শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকি, ঠিক তেমনি আমার শিক্ষার্থীদের কখনো নিজের সন্তান ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। যে কারণে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আজও আমায় মনে রেখেছে।

আমি যখন ক্লাস নিতাম, তখন শুরুতেই আগে বলতাম চার দেয়ালের ভেতরে যারা আছ, তারা সবাই আমার ছাত্র-ছাত্রী। কে মন্ত্রীর ছেলে, কে কোটিপতির সন্তান, তা এখানে চলবে না। এখানে সবার পরিচয় শিক্ষার্থী। তোমরা সবাই আমার সন্তানের মতো। তাই আমি মনে করি একজন শিক্ষকের সঙ্গে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সম্পর্ক হবে বাবা-সন্তানের মতো। তবেই তারা শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসবে।

শিক্ষার্থীদের সফলতার পেছনে মূলত কাজ করেন একজন শিক্ষক, এমনটা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পাস করতে পারে না। অনেকভাবে প্রাইভেট পড়েও খারাপ রেজাল্ট করে। অভিভাবকসহ শিক্ষকরা তাদের বকাবকি করে। আসলে এখানে শিক্ষার্থীদের কোনো ভুল নেই। একজন শিক্ষার্থী তখনই সবকিছু বুঝবে, যখন তাকে সঠিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে। একজন শিক্ষকের কাছে সে না বুঝলে তাকে অন্য শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হবে। একজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে বানাবেন, সে সেভাবেই গড়ে উঠবে।

যেমন উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, গরুর মাংস প্রতি বাসায় রান্না হয়, তবে একেক বাসার রান্নার স্বাদ একেক রকম। একই মাংস, একই মসলা, কিন্তু রান্নার স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। কারণ, কারিগরটি আলাদা। তাহলে এটা থেকেই বোঝা প্রয়োজন যে একজন শিক্ষক ঠিক যেভাবেই শিক্ষার্থীকে বোঝাতে সক্ষম হবেন, সেই শিক্ষার্থী ঠিক সেভাবেই তৈরি হবে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তার পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখামুখী করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। যখন একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বেড়ে উঠবে, তখনই তার পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। তখন যদি একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে যত্ন নেয়, সে শিক্ষার্থী সফলতার সিঁড়িতে উঠতে শুরু করবে।

শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষা তার অভিভাবকের কাছে, এমনটা মনে করে এই অধ্যক্ষ বলেন, বাসায় শুরু হয় একজন শিক্ষার্থীর মূল শিক্ষা, স্কুল বা কলেজে নয়। আর সেটি হবে সেই শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের কাছ থেকে। মা-বাবাই পারবেন সেই সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে।

শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল ছেড়ে সন্ধ্যার পর মাঠ কিংবা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বসে আড্ডা দেয়, এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ বলেন, আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি, কখনো সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকিনি। আর আজকাল অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েদের দেখা যায় সন্ধ্যার পরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। এটা ঠিক নয়। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আর এটা পরিবর্তন করতে হলে অভিভাবকদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তাদের খবর রাখতে হবে সন্তান কোথায় গেল, কেন গেল, এত দেরি করছে কেন, কার সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে— সব বিষয় নজরে রাখতে হবে।

মাতৃভাষার প্রতি সবাইকে সম্মান দিতে হবে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা অনেকে অনেক জায়গায় চাকরি করে থাকি। কিন্তু আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে নিজের মাতৃভাষা কখনো ভোলা যাবে না। এই মাতৃভাষা হলো আমাদের মায়ের ভাষা। মা যে ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছেন, সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। এইা ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি। যে যেখানেই যাই, যেভাবেই কথা বলি না কেন, নিজের মাতৃভাষা কখনো বাদ দেওয়া যাবে না।

আমি নিজে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করেছি। কখনো নিজের মাতৃভাষা ভুলিনি। অনেকেই হাসাহাসি করে, সেটা দেখে আমার কোনো কিছু যায় আসে না। কারণ, আমি আমার মাতৃভাষাকে ভালোবাসি।

ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ৩৩ বছর শুধু শিক্ষকতা করিনি, দিনাজপুর কলেজের স্টুডেন্ট কাউন্সিলর ছিলাম। খেলাধুলা, গানবাজনাসহ বিভিন্ন সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলাম আমি। এখন আমি অবসরে রয়েছি। তাই বলে কি জীবনের কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না? অবশ্যই রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত করার জন্য। শুধু দুনিয়াদারি করলে হবে না, ইবাদতও করতে হবে। সুরা আলাকে বলা আছে, ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। অর্থাৎ আল্লাহর নামে পড়ো।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –