• মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

তারা হয়েছেন সম্মানিত, খেয়েছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০২২  

তপ্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় রঙিন প্যান্ডেল। ভেতরে একাধিক বৈদ্যুতিক পাখা। সাজানো টেবিলে নানা পদের খাবার। মেন্যুতে রয়েছে পোলাও, মাংস, ডিম, ডাল, মিষ্টি, কোমলপানীয়। দামি কাপড়ে মোড়ানো চেয়ারে বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন ‘অতিথি’রা। খাওয়া শেষে মূল প্যান্ডেলের বাইরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে টিস্যুতে মুছছেন। এরপর টেবিলে রাখা পান-সুপারি মুখে পুরে চিবোচ্ছেন।

পুরো আয়োজনটি চমৎকারভাবে সাজানো। মনে হতে পারে হয়তো নামী-দামী বা সমাজের অভিজাতদের জন্য এমন আয়োজন। যারা পরিপাটি কাপড়চোড় পরে সেজেগুজে বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে এসেছেন। মোটেই তা নয়।

ব্যতিক্রমী এই আয়োজনে মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য। যারা এ অনুষ্ঠানে যারা মূল অতিথি। তাদের বেশির ভাগের পরিধেয় কাপড় মলিন, কারওটা ছেঁড়া। অনেকের পায়ে নেই জুতা।

সোমবার (১১ জুলাই) দুপুরে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ কেইউপি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ লাগোয়া একটি জায়গা ঈদ উপলক্ষে এ আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে অসহায়, দরিদ্র কিংবা প্রতিবন্ধী শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন মানুষ সম্মানের সঙ্গে আপ্যায়িত হয়েছেন। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন।

স্থানীয় নানা পেশার কয়েকজন মানুষ পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো এ আয়োজন করেছিলেন সোমবার (১১ জুলাই)। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ঈদে কষ্ট মানুষের পাশে’।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, ঈদে নিজেদের বাড়িতে দেয়া কোরবানির মাংস তারা একত্র করেছেন। এরপর নিজেরাই টাকা দিয়ে বাকি আয়োজন করেছেন। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান কিংবা ঈদে যেসব মানুষদের সাধারণত কেউ দাওয়াত দেয় না, মূলত তাদেরই দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছে এ আয়োজনে।

অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসা ৮০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল খালেক বলেন, ঈদের আগেৎ হামার বাড়িৎ আসি ছ্যাওয়া (ছেলে) গুইলা সম্মানের সহিত দাওয়াত দিছে। দাওয়াতে আসিয়া হামা এত খাবার দেখিছি মন ভরি গেইছে। বড় নিঃশ্বাস ফেলছিৎ হামা গিইলা (আমরা)। এত খাবার ক্যামন করি খাইম। ছ্যাওয়াগুইলা হামাক যে যত্ন করছে, এটা ভুলির পাইম না কোন দিন।  
 
রোকসানা বেগম বলেন, ভিক্ষা কররি গিয়া অনেক বাড়ির সামনে দ্বারে থাকোৎ। কিন্তু হামাক বাড়িও সামনে থাকি অনেক মানুষ ধুর ধুর করি তারে দেয়। কিন্তু ছ্যাওয়াগুইলা যেভাবে দাওয়াত দিল, কওয়ার (বলার) মতো নয়। আয়োজন দেখি মনে হইছিল হামরা বুঝি বড় লোকের সন্তান। যারা এই আয়োজন করি দাওয়াত দিচ্ছে, আল্লাহ তাদের অনেক বড় করুক।
 
আসমা বেগম নামের আরেক নারী বলেন, গত বছর ওমার দাওয়াতে আছুনুৎ (তাদের দাওয়াতে এসেছিলাম)। তখনো হামাক চেয়ার-টেবিলে বসি খাওয়াছে। এবারও হামা (তাই গত এক বছর) এই দাওয়াতের অপেক্ষা করেছুৎ।

করোনাকালীন কাজ না পেয়ে অনেক কষ্টে ছিলেন তারা। তাদের কথা চিন্তা করে অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ঈদে কষ্ট মানুষের পাশে’। আর এই নামের কারিগর ৯ বছর বয়সী হিসনে হাসিন।

হাসিনের মা শিক্ষক আরিফা সুলতানা বলেন, করোনার সময় শত শত মানুষ না খেয়ে কষ্টে ছিলেন। এসব চিত্র দেখে মেয়ে তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে বলেছিল। ওই সময় তার বাবা সাংবাদিক হায়দার আলী বাবু উদ্যোগ নিলে সেটি সফল হয়। এগিয়ে আসেন অনেক স্বেচ্ছসেবী যবুক। ভালো কাজের সঙ্গে সবাই থাকে। তাই ভাবছি পরেরবার আরও বড় করে আয়োজনটি করব।

আয়োজকদের একজন আজাদ আলী বলেন, বিভিন্ন পেশার কয়েকজন মানুষ মিলে আমাদের এ আয়োজন। আমরা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মুখে অন্তত এক দিন সাধ্যমতো সম্মানের সঙ্গে খাবার তুলে দিতে পারি, এ রকম চিন্তা থেকেই এই আয়োজন।

আরেক আয়োজক রেফাজ রাঙ্গা বলেন, উদ্যোগটি মূলত সাংবাদিক হায়দার আলী বাবুর। এই আয়োজনে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদসহ আমরা অনেকে যুক্ত হয়ে সামান্য কিছু করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা চাই আমাদের মতো সারা দেশেই এমন আয়োজন হোক।

সাংবাদিক হায়দার আলী বাবু বলেন, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা দরিদ্র মানুষ আমাদের ভাষায় ‘কষ্টমানুষ’। করোনা মহামারির সময় কষ্টমানুষ প্রজেক্টের আওতায় কর্মহীন নানা পেশার মানুষের জন্য আমরা ত্রাণসহায়তা করেছি কয়েক দফা। আর গত বছর ঈদুল আজহার পরদিন পুরোপুরি আয়োজন করে দরিদ্র মানুষদের আপ্যায়ন করার কাজটি শুরু করেছি। ভবিষ্যতেও আমাদের চেষ্টা থাকবে একাধিক স্থানে এমন আয়োজন করার।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –