• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

আজ রক্তস্নাত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে গভীর শোক ও বেদনার দিন, একই সঙ্গে গৌরবেরও। দিনটি আজ আর শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের।

সব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা অনুপ্রেরণার অবিরাম উত্স। মর্যাদার একুশ একাধারে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দিনটি শ্রদ্ধাভরে পালন করছে। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এর আবেদন অন্যরকম। বাঙালিদের কাছে আজ রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। 

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সালাউদ্দিনসহ সবাইকে আজ স্মরণ করা হয়। জাতি বিনম্রচিত্তে ভাষাশহিদ সূর্যসন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ১৯৫২ সালের এদিনে 'বাংলাকে' রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সেসময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখরাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা রক্ষা আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলে। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে কয়েকজন শহিদ হন।

কিন্তু মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে প্রাণ দেওয়া শহিদদের স্মরণে দেশে স্থাপিত শহিদ মিনারগুলো একেক স্থানে একেক কাঠামোর। এই রকম বানানোর ইতিহাস ও প্রতিপাদ্য লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আদল যাই হোক না কেন, শহিদ মিনার কাছাকাছি একই বার্তা নিয়ে নির্মিত। যদিও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাঠামো, নকশা অনুসরণ করে দেশে-বিদেশে একই আদলে শহিদ মিনার নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে গত বছরের ১৪ জুন রুল জারি করেন হাইকোর্ট। 

কিন্তু বিবাদীদের কাছ থেকে কোনো জবাব আসেনি। সেই রুলের সমাধান না হলেও আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, দেশজুড়ে যতো শহিদ মিনার হয়েছে সেসবে স্থাপত্যশৈলীতে পার্থক্য থাকলেও থিম কাছাকাছি থেকেছে; আমাদের যে দৃঢ়তা, শহিদদের যে আত্মত্যাগ সেসবই এর প্রতিপাদ্য।

কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের নকশার দিকে তাকালে দেখা যায়, এতে রয়েছে মোট পাঁচটি স্তম্ভ। মাঝখানের স্তম্ভটি সবচেয়ে উঁচু, ওপরের অংশটি সামনের দিকে নোয়ানো। দুই পাশে আরো চারটি স্তম্ভ। মনে করা হয়, অতন্দ্র প্রহরী চার সন্তানকে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মা।

রাজশাহীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে বানানো শহীদ মিনারটিরও থিম ছিল দৃঢ়তা ও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো উল্লেখ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজশাহী কলেজের সিনিয়র ছাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোলাম আরিফ টিপু (বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর) বলেন, ‘সেই রাতের সিদ্ধান্তে একদিনের মধ্যে তৈরি হলো মিনার। কোথা থেকে একটা ভাঙাচোরা ক্যামেরা এনে সেইদিন ছবিও তুলে রাখা হয়েছিল। এদিকে আমরা সারা রাত জেগে শহিদ মিনারটি নির্মাণ করি। পরদিন সকালে হরতালের পিকেটিং করার জন্য আমরা সবাই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। এ সময় পুলিশ এসে শহিদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। 

পরবর্তী সময়ে যতগুলো শহিদ মিনার হয়েছে সবগুলোরই বার্তা ছিল— ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’, আমাদের যে দৃঢ়তা, শহীদদের যে আত্মত্যাগ সেসবই।’

১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে বাঙালিদের রাজপথে জীবনদানের স্মরণে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলে পুলিশ। এরপর ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বর্তমান স্থান নির্বাচন করে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশায় নির্মাণযজ্ঞে যুক্ত হন ভাস্কর নভেরা আহমদ। মূল রূপ কল্পনায় ছিল স্নেহময়ী আনত মস্তক মায়ের প্রতীক হিসেবে মধ্যস্থলে সুউচ্চ কাঠামো এবং দুই পাশের সন্তানের প্রতীক স্বরূপ দুটি করে কাঠামোর সামনে বাঁধানো চত্বর। সম্মুখ চত্বরে দুটি ম্যুরাল। পেছনে দেয়ালচিত্র। ছিল বেদনাঘন শহিদ দিবসের প্রতীক হিসেবে একটি ফোয়ারা স্থাপনের পরিকল্পনা। আরো ছিল একটি জাদুঘর ও পাঠাগার।

এ পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫৭ সালে শুরু হওয়া কাজ ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। তার পরও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত শহিদ মিনারেই ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, শপথ গ্রহণ ও আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পরিবর্তন ও সংকুচিত একটি নকশানুযায়ী নির্মিত শহীদ মিনার ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।

কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে অভিন্ন শহিদ মিনার তৈরি করতে ২০২১ এর মে মাসে সারাদেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নকশা পাঠানো হয়েছে। সেসময় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে নকশা ও যাবতীয় শহিদ মিনার তৈরির তথ্য পাঠানো হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অফিস আদেশে নির্ধারিত মাপ ও ডিজাইনে দুটি অপশন রেখে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সুবিধাজনক স্থানে শহিদ মিনার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –