• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ঢাকার সাভারে এক মায়ের চুল বিক্রির ঘটনা যেন আরেকটি বাসন্তী নাটক   

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২০  

ঢাকার সাভারে এক মায়ের চুল বিক্রি করে বাচ্চার দুধ কেনার ঘটনা নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘটনার পরেই দিনই নেপথ্যে থাকা সব ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। 
গত (২১ এপ্রিল) থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনার অনুসন্ধান করে যা বের হলো-

ডেটলাইন ২১ এপ্রিল

একটি ফেসবুক আইডিতে দেখা যায়, সাভারের ব্যাংক কলোনির জিমের গলির এক ভাড়া বাসায় এক মা দু-একদিন আগে করোনায় অভাবগ্রস্ত হয়ে চুল কেটে তা বিক্রি করে সন্তানের দুধ ক্রয় করেন। ঘটনাটি ভাইরাল হয় এবং এ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন হয় টিভি চ্যানেল, পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমে। এরপর থেকে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন পুলিশ, র‌্যাব, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষ।

খুঁজে বের করা হয় ব্যাংক কলোনির সেই জিমের গলির বাড়ি। সেখানে ভাড়া বাসায় সাথী আক্তার (২২) থাকেন। তিনি দুই সন্তানের জননী, বড় ছেলে জুনায়েদ (৫) ও ছোট ছেলে জুবায়ের (২)। স্বামীর নাম মানিক (২৫)। তারা কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন কাজের জন্য। রাজধানীর মিরপুরে বসবাস করেন এক বস্তিতে। সেখানে কাজকর্ম না থাকায় সাভারের ব্যাংক কলোনিতে চলে আসেন গত দুই মাস আগে।

সাথী ও তার স্বামী মানিক জানান, ব্যাংক কলোনিতে আসার পর তারা অপরিচিত বিধায় কারও কাছে কিছু না বলে কিছুদিন কষ্টে দিন যাপন করেন। প্রায় দেড় মাস আগে সাথী স্থানীয় হকারদের কাছে মাথার চুল বিক্রি করে পান ১৮০ টাকা। যে ভাড়া বাসায় তিনি থাকেন সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ১০টি পরিবারের সকলেই কাজের বুয়া। করোনার প্রভাবে অনেকে কষ্ট করলেও কোনোরকম তাদের পেট চলে যাচ্ছিল। সাথীর মাথায় চুল না থাকার কারণটি প্রথম তার প্রতিবেশী এক মহিলা জানান পাশের এক বাড়িতে। সেই বাড়ির লোকজন ফেসবুকে পোস্ট দিলে ঘটনাটি সবাই জানতে পারেন।

ফেসবুকের পোস্ট দেখে সবাই মনে করেন যে, করোনায় অভাবগ্রস্ত হয়ে সাথী তার মাথার চুল বিক্রি করে দিয়েছেন। এভাবে ঘটনাটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং সবাই মানবিক সাহায্য নিয়ে আসেন সাথীর বাসায়।

এ প্রসঙ্গে সাথী বলেন, যখন চুল বিক্রি করেছি তখন করোনার কোনো প্রভাব সংসারে পড়েনি। তবে করোনায় এখন অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। ফেসবুকের পোস্ট ও টেলিভিশন সংবাদ দেখে সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজিব, সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজুর রহমান জুম্মন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মাহফুজ, সাভার পৌর মেয়র হাজি আব্দুল গণি, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হাসান তুহিন ঘটনাস্থলে যান। এছাড়া র‌্যাব-৪ এর কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছুটে যান সাথীর বাসায়। এগিয়ে আসেন মানবিক সাহায্য নিয়ে।

এ ঘটনার ভুল তথ্য দিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং সংবাদ পরিবেশিত হওয়ায় দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সংবাদ পরিবেশনের পর থেকে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অনেকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সচেতন মহল— সবাই সাহায্য করতে গিয়ে জানেন আসল তথ্য।

যেভাবে ফাঁস হলো আসল ঘটনা

২১ এপ্রিলের ঘটনা সবার মনে মানবতাবোধের জন্ম দেয়। সাহায্য করতে গিয়ে সকলেই কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করেন, সাথী কীভাবে এবং কখন তার মাথার চুল বিক্রি করলেন। এ সময় সাথী ও তার স্বামী মানিক কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে সাভার আসার বিষয়টি বর্ণনা করেন। প্রায় দেড় মাস আগে চুল বিক্রি করেন বলেও তারা জানান।

করোনার কারণে তারা চুল বিক্রি করেছেন কি-না, জানতে চাইলে বলেন, দেড় মাস আগে চুল বিক্রি করেছি, তখন এত করোনা ছিল না। তবে বিক্রি করেছি। বিষয়টি জানার পর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচার। আসল ঘটনা তদন্তের দাবিও করেন তিনি।

ডেটলাইন ২২ এপ্রিল

২২ এপ্রিল সকালে সাথীর বাসায় প্রচুর লোকের ভিড়। সকলেই মানবিক সাহায্য নিয়ে সাথীর বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। এমন সময় ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী। তিনি সংবাদকর্মীদের সামনেই সাথী ও মানিককে জিজ্ঞাসা করেন, চুল কাটার ঘটনাটা কী? এ সময় সাথী ও মানিক জানায়, মিরপুর থেকে সাভার আসার পর অপরিচিত স্থানে কাউকে কিছু না জিজ্ঞাসা করেই হকারের কাছে মাথার চুল বিক্রি করে দেই। এতে করোনার কোনো প্রভাব নেই। এ সময় মাসুদ চৌধুরী বলেন, সাথী ও তার পরিবার ষড়যন্ত্রের শিকার। বাংলাদেশে সাথীকে দিয়ে আরেকটি বাসন্তী সাজিয়ে সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে একটি মহল।

তিনি আরও বলেন, ফেসবুক স্ট্যাটাস ও টিভি সংবাদে ভুল তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ঘটনার দায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হাসান তুহিন বলেন, ঘটনাটি ফেসবুক ও টিভি সংবাদে প্রচার হওয়ার পর ২১ এপ্রিল রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারি আসল তথ্য। এরপরও মানবিক সাহায্য থেমে নেই।

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক জানান, বিষয়টি জানার পর আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাথী ও তার স্বামীর সাথে কথা বলেছি। এ সময় আমি জানতে পারি যে, গ্রামগঞ্জের মা-বোনেরা যেভাবে স্বাভাবিক চুল বিক্রি করেন সাথী সেভাবেই চুল বিক্রি করেছেন। এতে করোনার কোনো প্রভাব নেই। তিনি এ সময় গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

সাভার মডেল থানা পুলিশও বিষয়টি তদন্ত করে। তারা জানায়, মিরপুর থাকাকালীন সাথীর মাথায় ঘা হয়। ঘা নিয়ে তারা সাভারে চলে আসেন। এ সময় সাথীর মাথার চুল তার স্বামী চেছে দেন। সেই চুল বিক্রি করেন সাথী। এটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –