• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী :ফিরে দেখা

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২১  

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ রাজপথে সমুদ্রের ঢলের মতো, উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের মতো, উল্লাস, নর্তনের এক উত্সব মুখরিত মহামিলনের মহোত্সবে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবা ডা. মোকাদ্দেম আমার ছোট বোনকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে চলে এসেছিলেন। এটা ছিল ৯ মাসের রুদ্ধ দ্বার জেলখানায় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনার পর, হঠাত্ ফাটক ভেঙে বেরিয়ে আসার আনন্দোচ্ছ্বল মুহূর্ত। অন্ধকারমুক্ত এক অবারিত আলোর বন্যা। হানাদারকে তাড়ানোর গর্বে, মেশিন গানের বিরুদ্ধে জনতার লাঠি নিয়ে লড়াইয়ের দুঃসাহসী অভিযানের শেষে সাফল্য অর্জনের গর্বে আমাদের বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আমাদের পাশে ছিল আমাদের বীর গেরিলা সন্তানেরা। ছিল মিত্রবাহিনী। ছিল মুষ্টিমেয় হানাদার বাহিনীর সহযোগী ব্যতীত সমগ্র জনগণ।

আমি ১৬ বছরের বালক ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আমাদের বৃহত্ একান্নবর্তী পরিবারের বৃহত্ বাসাটিতে, সেন্ট্রাল রোডের ‘দারুল আফিয়া’—এখন যেটা ভেঙে আধুনিক একটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, সেখানেই প্রথম পদার্পণ করি। যখন যুদ্ধ শেষে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তখন আমাদের উভয়ের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছিল। দেখছিল আমার কৃশ দেহ, আমার চোখে ‘জয় বাংলা’ অসুখের ছাপ (তখন চোখের একটি মহামারিতে প্রায় সব আগরতলাবাসী আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা চোখের অসুখ!’), আমার চুল লম্বা, গালে দাড়ি গজিয়ে গেছে, একজন যুদ্ধ শেষে ফেরত আসা সন্তানের স্বাভাবিক একটি রূপ। বাসায় আনন্দের পাশাপাশি একটি দম আটকানো দুশ্চিন্তাও বিরাজ করছিল, কারণ তার দুদিন আগে এই বাসা থেকেই বদর বাহিনীর সদস্যরা মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে আমরা জেনেছি অনেক শহিদ বুদ্ধিজীবীর মতো বিজয়ের শেষ মুহূর্তে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু আজ ৫০ বছর পর যখন সেই স্মৃতি আমি রোমমন্থন করতে বসেছি তখন মনে হচ্ছে কোথায় যেন সব হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মৃতিও ম্লান হয়ে গেছে, বুড়িগঙ্গায়ও অনেক পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে। আমাদের জাতি আজ বহু মীমাংসিত এই মুহূর্তে অনেক মীমাংসিত বিষয়ে সম্পূর্ণ আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিজয় মুহূর্তেও মহামিলনের সূত্রটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি আমাদের আত্মপরিচয় কী হবে তাই-ই আবার প্রশ্ন বিদ্ধ আকারে উঠে এসেছে। একদল মনে করেন আমাদের আত্মপরিচয় হওয়া উচিত্ ‘বাঙালি মুসলমান’, আরেক দল মনে করেন “না, সেটা হওয়া উচিত ভাষা ভিত্তিক পরিচয়, অর্থাত্ ‘বাঙালি’।” অথচ আমরা কে বাঙালি—কে বাংলাদেশি তার চুলচেরা মীমাংসা না করেও দিব্যি কিন্তু জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। যখন পাসপোর্ট বহন করে বিমানবন্দর ত্যাগ করি অথবা অন্য দেশে পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াই তখন পরিচয় জানতে চাইলে ‘পাসপোর্ট’ দলিলটিই আমরা দেখাই। কারোরই তাতে কোনো দ্বিমত থাকে না। তাতে আমাদের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশীই’ লেখা থাকে এবং তখন সেটাই আমাদের পরিচয় হিসেবে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু অন্য সময়ে এটা মোটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। অমর্ত্য সেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Identity and Violence’ দেখিয়েছেন একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে বহু আত্মপরিচয় ধারণ করতে পারেন। একেক সময় একেকটি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আত্মপরিচয়কে একপেশে বা সার্বভৌম একে পরিণত করলেই পরস্পর আমরা ‘পরিচয় ভিত্তিক’ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। তা সমাজে অকারণে কখনো কখনো সংঘর্ষ ও অশান্তি ডেকে আনে। চতুর রাজনীতিবিদরা তখন তা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারও করেন।

এমনিতে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখুন, যখন দেশের ভেতরে শুক্রবার একজন বাংলাদেশি নাগরিক মসজিদে নামাজ পড়তে যান, তখন নামাজ শেষে বাংলা ভাষাতেই সবাই সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তখন তাকে একজন ‘মুসলমান বাঙালিই’ মনে করা হয়। আবার কোনো ‘বাংলাদেশি হিন্দু’ যখন মন্দিরে যান, পূজা দিয়ে বের হয়ে বাংলায় কুশল বিনিময় করেন (নিশ্চয় তিনি যেমন তখন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেন না, তেমনি এটাও সত্য যে, মুসলমান বাংলাদেশিরাও নামাজ শেষে আরবি ভাষা ব্যবহার করে কুশল বিনিময় করেন না!) তখন তাকে ‘বাঙালি হিন্দুই’ ভাবা হয়। আবার ধরুন যখন পহেলা বৈশাখে বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এক সঙ্গে শিশুদের নিয়ে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেন বা গ্রামে যখন হালখাতা খোলা হয় বা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয় তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি জাতি হিসেবে আমরা সবাই ধর্ম নির্বিশেষে ‘বাঙালি’ এবং আমরা সবাই ‘বাংলারই (বাংলাদেশের) জয়’ চাই, ‘পরাজয় নয়’। কিন্তু এভাবে কি উদারভাবে আমরা চিন্তা করতে পারছি। একজন বাঙালি, ভারতের অথবা বাংলাদেশের নাগরিক যখন বাংলাদেশ বনাম ভারতীয় ক্রিকেট ম্যাচটি দেখেন তখন সেই বাঙালিটি বাংলাদেশের সমর্থক হতে পাবেন আবার ভারতেরও সমর্থক হতে পারেন, তিনি হয়তো ভারতীয় বাঙালি হয়েও বাংলাদেশি টিমের সমর্থক হতে পারেন, আবার একজন বাংলাদেশি বাঙালি সাকিবের সমর্থক না হয়ে সৌরভের সমর্থক হতে পারেন। এসব উদার বহুত্ববাদী ধারণা অবশ্য একটি সমাজে একদিনে গড়ে উঠে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিন্তু সর্বোচ্চ উদারতা নিয়ে বহু আগেই এভাবে ভাবতে পেরেছিলেন যে তিনি যেমন একদিকে বাঙালি ছিলেন, তেমনি মুসমানও ছিলেন, আবার তিনি এটাও বলেছিলেন যে তিনি ‘মানুষও’ ছিলেন। বস্তুত ‘মানুষ’ না হলে আমরা কিন্তু কোনোটাই হতে পারব না। আমাদের কবিগুরু যথার্থই বলেছিলেন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে জননী, বাঙালি করেছ কিন্তু মানুষ করো নি।’ আজও আমাদের মানুষ হওয়ার সাধনা শেষ হয়নি।

শুধু কি এই ৫০ বছরে আমরা জাতিকে আত্মপরিচয়ের সংকটে বিদীর্ণ করে বিভক্ত করে ফেলেছি, শুধু এটুকু পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে আমাদের অনেক সমৃদ্ধিও অর্জিত হয়েছে, আমাদের দেশ আর হতদরিদ্র দেশ নেই। আমরা দেশ আজ সারা পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। আমরা প্রমাণ করেছি আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমরা বিদেশি সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতুকে দৃশ্যমান করেছি। পরিণত হয়েছি বিশ্ব নির্ধারিত সংজ্ঞানুসারে ‘নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে’। আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ সম্ভবত আর হবে না, এটাই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি, যদিও হয়তো ‘সুপ্ত ক্ষুধা’ (Endemic Hurger) এখনো বজায় আছে। আমাদের কৃষকরা সোনার বাংলায় অজস্র বহুমুখী সোনার ফসল ফলিয়েছেন, এ কথা তো সত্য। আমাদের নারী শ্রমিকরা পোশাকশিল্পে বিপ্লব সাধন করেছেন, এ কথাও সত্য। আমাদের প্রবাসীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা যুগিয়ে আমাদেরকে ‘বিদেশি সাহায্য ও পরনির্ভরতার’ গ্লানি থেকে মুক্ত করেছেন এ-ও সত্য। আমাদের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষরা অত্যন্ত উচ্চ হালে তথা শতকরা ২৪ থেকে শতকরা ৩০ ভাগ সুদে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তার ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ সময়মতো শোধ করে খেলাপি না হওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিছুটা দারিদ্র্যমুক্তও হয়েছেন। তবে এসব শ্রমজীবী মানুষদের সবার প্রতি আমরা কি ন্যায়বিচার করতে পেরেছিলাম, যাদের জন্য আমাদের এই অর্জন, তাদের জন্য আমরা কি করেছি? আজ এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সবাইকেই এই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা মধ্য ও উচ্চবিত্তরা স্বাধীনতার পর যতটা উপরে উঠতে পেরেছি, ততটা কি এই শ্রমজীবীরা পেরেছেন। অর্থনীতিতে তাদের যতটুকু অবদান ততটুকু হিস্যা কি তাদের বরাতে জুটেছে?

‘ন্যায় বিচার’ সহজ কোনো বিষয় নয়। এখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের প্রয়োজন হয়। গ্রিস দেবী থেমিটিসের মতো চোখ বন্ধ করে ‘পক্ষপাত শূন্য অন্ধতার’ প্রয়োজন হয়। আমরা যারা এ যাবত্ দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি, শাসন করেছি, শাসক দল এবং তার অনুগ্রহপুষ্ট হিসেবে জীবনযাপন করে এসেছি। তারা কি এই কঠিন বৈশিষ্ট্য ঠিকভাবে ধারণ করেছি। করতে পেরেছি? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উত্সবে শুধু অতীত কৃতিত্বের স্মৃতি রোমন্থন না করে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরা উচিত সত্যতার সঙ্গে। অর্ধসত্য নয়, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ নয় এবং মিথ্যা তো নয়ই। যদিও সারা পৃথিবী এখন ‘সত্য উত্তর’ (Post Truth) যুগে পদার্পণ করেছে। অক্সফোর্ড অভিধানেই ২০১৬ সালে সত্য-উত্তর সমাজের এই শব্দটি ‘অফিসিয়ালি’ গৃহীত হয়েছে এবং উদাহরণ হিসেবে বিশেষভাবে Populist বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের নাম তুলে ধরা হয়েছে যেমন—ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। তারা জনপ্রিয় বিশাল ভোট পান, কিন্তু আবার জনতাকে মিথ্যা বলতেও কসুর করেন না, যদি তা স্বার্থের জন্য ফলঃপ্রসূ হয় বা নিজের অবস্থানকে শক্ত করে। এই ধরনের সত্য-উত্তর সমাজের জন্য কিন্তু আমরা সংগ্রাম করিনি। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সমতা, ন্যায়বিচার, শোষণহীন সমাজ এবং গণতন্ত্র কায়েমের জন্য। শুধু বস্তুগত সমৃদ্ধির জন্য নয়। আসুন আজ এই শুভক্ষণে আমরা আবার মানুষ হই এবং পূর্বপুরুষের ঋণ পরিশোধ করে তাদের এই মহত্ স্বপ্লগুলো বাস্তবায়নের জন্য স্বচেষ্ট হই। স্মৃতিকাতর হয়ে সবার প্রতি এইটুকুই আমার সেন্টিমেন্টাল আবেদন।

লেখক : ড. এম এম আকাশ
অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –