• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

বিসমিল্লাহর তাৎপর্য ও উপকারিতা

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০১৯  

দুনিয়ার বুকে প্রথম মানুষ আগমন করেছিলেন হজরত আদম (আ.)। তিনি সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না, নবী ছিলেন।

তার পর দুনিয়ার বুকে বহু নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। তাদের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে শরীয়ত বা বিধিবিধান। কারো বেলায় পূর্বের নবীর বিধিবিধান বলবৎ থাকতো। তবে দুনিয়ার বুকে রাসূল হিসেবে যাদের প্রেরণ করা হয়েছে, তাদের সকলকে নতুন শরীয়ত দেয়া হয়েছে। এখান থেকে আমরা নবী ও রাসূলের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারি। নবী হচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যাকে নতুন শরীয়ত দেয়া হতে পারে, আবার নাও দেয়া হতে পারে। রাসূল হচ্ছেন, যাকে নতুন শরীয়ত দেয়া হয়েছে। নবীগণের মাঝে রয়েছে মর্যাদাগত পার্থক্য। আল কোরআনে বলা হয়েছে-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِّنْهُم مَّن كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ

অর্থ: এই রাসূলগণ-তাদের কতককে কতকের ওপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। তাদের মধ্যে কেউ তো এমন, যার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন এবং কাউকে বহু মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। (সূরা: বাকারা: ১৫৩) পার্থক্যের বহু দিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কারো শরীয়তকে আল্লাহ তায়ালা সহজ ও আসান করে দিয়েছেন। অল্প আমলে বেশি নেকি লাভের পথ উম্মোচন করেছেন কারো কারো ক্ষেত্রে। সৌভাগ্যবান মুসলিম উম্মাহ। উল্লেখিত দুটি বৈশিষ্ট্যই ইসলামি শরীয়তে রয়েছে। ইসলাম হচ্ছে সহজ ব্যবস্থা, এখানে কঠোরতার কোনো স্থান নেই। বরং যে কঠোরতা করবে সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে। নবী করীম (সা.) বলেন-

عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : ( إن الدين يسر ولن يشاد الدين أحد إلا غلبه فسددوا وقاربوا وأبشروا واستعينوا بالغدوة والروحة وشيء من الدلجة

আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ইসলাম হচ্ছে, সহজ একটি ব্যবস্থা। দীনের ব্যাপারে কঠোরতা করে কেউ সফল হতে পারেনি। অতএব, তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং পরস্পর মিলেমিশে থাক। কম আমলে বেশি নেকির সুসংবাদ দাও। তোমরা আল্লাহর কাছে সকাল, সন্ধা ও রাতের শেষাংশে সাহায্য চাও। (সহীহ বুখারী-৩৯)

ইসলাম হচ্ছে কম আমলে বেশি নেকি লাভের ধর্ম। এ প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ায় তোমাদের থাকার সময় পূর্ববর্তীদের তুলনায় খুবই কম। দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কে যদি এক দিন ধরা হয় তাহলে অন্যদের সময় হচ্ছে, দিনের ফজর থেকে আসর পর্যন্ত আর তোমাদের সময় হচ্ছে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত (তবে তোমাদের আমলের পাল্লা ভারী হবে)।

ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে কিছু কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে, তাদের বেতন ঠিক করে। বেতন ঠিক করার পদ্ধতি অনেকটা এ রকম যে, মনিব কর্মচারীদেরকে বলে, ফজর থেকে যোহর পর্যন্ত এক কিরাতের (তৎকালিন সময়ের মুদ্রা) বিনিময়ে কে কাজ করে দিবে? ইহুদিরা এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। তারপর মনিব বলে, যোহর থেকে আসর পর্যন্ত ওই পরিমান টাকার বিনিময়েই কে কাজ করে দিবে? তখন খ্রিস্টানরা রাজি হয়। তারপর সে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলে, তোমরা আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কাজ করবে আর বিনিময়ে পাবে দুই কিরাত পরিমান মুদ্রা। এ কথা শুনে অন্যরা বলে ওঠে, আমরা বেশি কাজ করে, কম বিনিময় পেয়েছি। তাদের কথা শুনে মনিব বলে, আমি কি তোমাদের উপর জুলুম করেছি? কর্মচারীরা বলে, না। তারপর মনিব বলে, এটা আমার অনুগ্রহ, আমি যাকে ইচ্ছা দান করি। (সহীহ বুখারী-৪৭৩৩)

প্রিয় পাঠক! ইসলাম হচ্ছে সহজ ও কম আমলে বেশি নেকি লাভের ধর্ম। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে কাজের শুরুতে বিসমিল্লার আমল। সহজ শব্দ কিন্তু এর দ্বারা লম্বা সময় পর্যন্ত আল্লাহর যিকির না করেও যিকিরের ছওয়াব লাভ করা যায়।

বিভিন্ন ধর্মে কাজ শুরু করা পদ্ধতি:

প্রাগৈসলামিক যুগে আরবের মুশরিক সম্প্রদায় বিভিন্ন মূর্তির নাম নিয়ে কাজ শুরু করতো। অন্যন্য আসমানী ধর্মের অনুসারী যেমন ইহুদি, খ্রিস্টান তারাও স্রষ্টার নামে কাজ শুরু করতো। কিন্তু ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নির্দিষ্ট এই বাক্য দিয়ে ইহুদি, খ্রিস্টানদের কাজ শুরু করার বিষয়টিকে, অনেক শরীয়তবেত্তা নাকচ করেছেন। ইসলাম জাহেলি যুগের রসম এবং শুধুমাত্র সৃষ্টার নামে শুরু করার রীতিকে পরিবর্ত করেছে। তদ্বস্থলে নির্দিষ্ট বাক্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, দ্বারা শুরু করার রীতি প্রবর্তন করেছে। অতএব, বিসমিল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছু দ্বারা কাজ শুরু করলে সুন্নত আদায় হবে না।

বিসমিল্লাহ দিয়ে কাজ শুরু করার হিকমত:

আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি কাজ ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করার নির্দেশ দিয়ে মূলত বান্দার কাজের রুখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কাজের শুরুতে বান্দার ‘বিসমিল্লাহ’ বলার অর্থ হচ্ছে, সে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছে যে, আমার কোনো কাজ আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্য ছাড়া হতে পারে না। এর দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে মুমিনের কাজের সম্পর্ক স্থাপন হয়। এবং বান্দার জাগতিক কাজও আল্লাহ তায়ালার নিকট ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

বিসমিল্লাহ এর বিধিবিধান:

মাসয়ালা : ফকিহগণের মতে তারাবির নামাজে একবার পুরো কোরআন খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। খতম করার সময় একটি আয়াত ছুটে গেলেও সুন্নত আদায় হবে না। এ জন্য, হাফিজ সাহেবের উচিত, কোনো একদিন তারাবির নামাজে বিসমিল্লাহ উচ্চ আওয়াজে পড়া। (আব্দুল হাই লক্ষনবি, সিয়াহ শরহে বেকায়া, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা-১৭০)

মাসয়ালা : নামাজের প্রত্যেক রাকাতের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদসহ আরো বহু ফকিহের নিকট ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর মতে সুন্নত। তাই নামাজ যেন সর্বসম্মতিক্রমে শুদ্ধ হয়, সে জন্য ফাতেহার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া উচিত। (আব্দুল হাই লক্ষনবি, সিয়াহ শরহে বেকায়া, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬৯)

মাসয়ালা : বহু সাহাবা, তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদের (রাহ.) মতে বিসমিল্লাহ কোরআনের একটি আয়াত। আবার এর বিপরীতে অনেকের মত হচ্ছে, সূরা নামলের অন্তর্ভূক্ত বিসমিল্লাহ কোরআনের আয়াত হলেও, প্রত্যেক সূরার শুরুর বিসমিল্লাহ কোরআনের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং দুই সূরার মাঝে পার্থক্যকারী বিষয় হিসেবে বারবার নাজিল করা হয়েছে। এই মতানৈক্যের কারণে, উলামায়ে কেরাম বলেন, কোরআনের ইজ্জত সম্মান সংশ্লিষ্ট যাবতিয় বিধিবিধান বিসমিল্লাহর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ ওজু ছাড়া যেমন কোরআন স্পর্শ করা যায় না, বিসমিল্লাহকেও স্পর্শ করা যাবে না। অন্য ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহর হুকুম কোরআনের মতো হবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি নামাজে কেরাত হিসেবে শুধু বিসমিল্লাহ পড়ে তাহলে তার নামাজ হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৩)

মাসয়ালা : ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) মতে সূরা ফাতেহা পড়ার পর, অন্য সূরা মিলানোর শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া সুন্নত নয়। ইমাম মুহাম্মাদ (রাহ.) এর মত হচ্ছে, উচ্চ আওয়াজের কেরাতে তা ছেড়ে দেয়া উত্তম আর নিম্ন আওয়াজের কেরাতে তা পড়া উত্তম। এ সকল মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সূরা ফাতেহা পড়ার পর, অন্য সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ না পড়া। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৩)

মাসয়ালা : কোথাও বিসমিল্লাহ লেখা দ্বারা যদি অসম্মানির আশংকা থাকে তাহলে বিসমিল্লাহ মুখে বলে, ৭৮৬ সংখ্যা লিখে দিলে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। (ফতোয়ায়ে উসমানী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৬৪)

বিভিন্ন তদবীরে ‘বিসমিল্লাহ’

(এক) মুশকিল আসান ও প্রয়োজন পূরণের জন্য : বার হাজার বার ‘বিসমিল্লাহ’ পড়বে। পড়ার পদ্ধতি হচ্ছে, এক হাজার বার পড়ে, কমপক্ষে একবার দরুদ ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দোয়া করবে। তারপর উক্ত পদ্ধতিতে আরো এক হাজার বার। এভাবে বার হাজার বার পূরণ করলে, এর বরকতে মুশকিল আসান হবে এবং প্রয়োজন পূর্ণ হবে- ইনশাআল্লাহ।

(দুই) চুরি ও জ্বিন শয়তানের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষার জন্য : কোনো ব্যক্তি ঘুমের আগে একুশ বার বিসমিল্লাহ পড়ে ঘুমালে, আল্লাহ তায়ালার রহমতে চুরি, জ্বিনের প্রভাব ও হঠাৎ মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে।

(তিন) মেধা ও মুখস্থশক্তি বৃদ্ধির জন্য : মেধা বা মুখস্থশক্তি দুর্বল কোনো ছাত্র যদি সাতশ ছিয়াশি বার বিসমিল্লাহ পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে, সূর্য উদয়ের সময় তা পান করে তাহলে তার মেধা ও মুখস্থ শক্তি বৃদ্ধি পাবে- ইনশাআল্লাহ।

আমরা কত গাফেল!

প্রিয় পাঠক! নবী করীম (সা.) বলেন-

كل امر ذى بال لا يبدا فيه ببسم الله الرحيم اقطع

গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ বিসমিল্লাহ ছাড়া শুরু করলে তা অসম্পূর্ণ (যদিও বাহ্যিকভাবে তা হতে পারে পরিপূর্ণ)। কারণ, বিসমিল্লাহ দিয়ে কাজ শুরু করা দ্বারা যতোটুকু বরকত হতো, বিসমিল্লাহ ছাড়া শুরু করা দ্বারা কখনো তা আশা করা যায় না।

এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবায়ে কেরামের একটি দল এসে নবীজি (সা.) এর কাছে অভিযোগ করলো, আমরা খাবার খাই কিন্তু পেট ভরে না। নবীজি (সা.) বললেন, তোমরা একসঙ্গে খাবে এবং খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলবে। তারপর থেকে আল্লাহর রহমতে পেট ভরা শুরু হলো। (আবু দাউদ-৩৭৬৬)

প্রিয় পাঠক! খাবার মানুষের দৈহিক বেঁচে থাকার মাধ্যম। আত্মিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন জ্ঞানের; যাকে দীনি পরিভাষায় ইলম বলা হয়। এক সময় বাঙ্গালি মুসলমানদের ঐতিহ্য ছিলো শিক্ষা-দীক্ষাসহ যাবতীয় কাজ ‘বিসমিল্লাহ’ ‘রাব্বি যিদনী ইলমা’ দিয়ে শুরু করা। তখন আর্থিক অভাব-অনটন থাকলেও সমাজে শান্তি ছিলো। ছিলো পরস্পর সৌহার্দ্য ভালোবাসা। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আজ আমরা সেগুলোকে শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বিদায় দিচ্ছি। তাই আজ আমরা অনেক কিছু শিখছি, কিন্তু কোনটা দিয়েই পেট ভরছে না। আমাদের সমাজ দিন দিন শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শূন্য হচ্ছে মনুষ্যত্ব থেকে।

অনেকে আমরা ভুলের শিকার। কারণ, অনেকে মনে করি শিক্ষা-দীক্ষা বিসমিল্লাহ, আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু করা মোল্লাদের কাজ। আমাদের তথা জেনারেল শিক্ষা-দীক্ষা শুরু হবে সাধারণভাবে। মনে রাখতে হবে, এগুলো মোল্লাদের জন্য নয়, মুসলমানের জন্য। মোল্লাও যেমন মুসলমান, আমি আপনিও তেমনি একজন মুসলমান।

শিক্ষা-দীক্ষায় এগুলো না থাকার কারণে আমাদের সন্তানেরা আল্লাহর রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানবিক কোনো উন্নতি হচ্ছে না শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা। এ জন্য, সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ভাইদের কাছে আবেদন, আমরা পূর্বসূরিদের ন্যায় জ্ঞানের জন্য ত্যাগ-কোরবানি দিতে পারবো না, কিন্তু এই সামান্য বাক্য ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে সবকিছু শুরু করতে পারবো তো ইনশাআল্লাহ?

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –