• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ আবদুল মান্নান

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২১ মার্চ ২০২১  

আবদুল মান্নান 

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেক দেশের এক বা একাধিক প্রতিবেশী দেশ থাকে। কোনো দেশ ইচ্ছা করলেও তার প্রতিবেশীকে বদলাতে পারে না। সুতরাং প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পারলে লাভ সংশ্লিষ্ট সবার। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় তা নানা কারণে হয়ে ওঠে না। এই উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান উভয়ের মাঝে বৈরী সম্পর্ক সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে একাধিকবার আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উভয় দেশের জনগণ। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ভালো নয়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অবনতির জন্য আফগানিস্তান সব সময় পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। তালেবান নামক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর আঁতুড়ঘর তো পাকিস্তানে। সেই তালেবান আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সব সময় ভালো। এতে লাভ উভয় দেশের। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি দেখে বেশ কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন প্রত্যাশা করে আসছে। সর্বশেষ গত ১৬ মার্চ পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সেই দেশের রাষ্ট্রপতি ড. আরিফ আলভির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি পাকিস্তানের প্রত্যাশার বিষয়টি পুনরুল্লেখ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত করার আগে অনেক অমীমাংসিত বিষয় সুরাহা করতে হবে। মিয়ানমার ছাড়া সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের পারদ বিভিন্ন সময় ওঠানামা করেছে।

একটি ভালো প্রতিবেশীর গুরুত্ব পরীক্ষা হয় তার কোনো প্রয়োজনে বা সংকটে। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম প্রতিবেশী। কভিড-১৯-এর কারণে কানাডাও সমস্যায় আছে। তাদের সেই সমস্যা কিছুটা লাঘব করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দিয়েছে তাদের সব মানুষকে টিকা না দিয়ে তাদের দেশে প্রস্তুত করা কোনো টিকা কানাডা বা মেক্সিকোতে যাবে না। এটিকে ঠিক প্রতিবেশীসুলভ আচরণ বলা যাবে না। এ দিক দিয়ে ভারতের আচরণ অনেকটা সংযত ও বন্ধুসুলভ। তারা তাদের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদন করা অক্সফোর্ডের টিকা প্রতিবেশীকে দিতে কার্পণ্য করেনি। প্রথম দিকে তো কয়েক লাখ ডোজ টিকা তারা উপহার হিসেবে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে বিনা মূল্যে দিয়েছে। কানাডাকে দিতেও রাজি হয়েছে ভারত।

যে বাংলাদেশ একসময় খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেই বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে বাংলাদেশ সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে তাদের খাদ্য সহায়তা করেছে। নেপাল এখন নিয়মিত বাংলাদেশ থেকে সার আমদানি করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তো রিলিফের চাল বা গম না এলে অনেক বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না। এই সময় খাদ্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই বাংলাদেশ এখন সীমিত আকারে সংকটকালে তার প্রতিবেশীকে খাদ্য সহায়তা দিতে সক্ষম। দু-একবার এমন হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভারত সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সেখানে খাদ্যসহ অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়েছে। ভারত সরকার পরে তার মূল্য পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেছে। মালদ্বীপে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গিয়েছে। এর আগেও মালদ্বীপকে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় তাদের প্রয়োজনে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে।
এবার আসি ভারত প্রসঙ্গে। ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষার মধ্যে তেমন একটা তফাত নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জনগণ, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের মানুষ যেভাবে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে সহায়তা করেছেন, তা এ দেশের মানুষ কখনো ভুলবে না। তাঁরা নিজেদের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন আমাদের দেশের শরণার্থীদের জন্য। নিজেদের অন্ন আমাদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন। তখন কিন্তু ভারতে নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হতো না। এমনও হয়েছে ‘জয় বাংলা’র মানুষের কাছ থেকে বাস কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে অস্বীকার করেছেন। কলকাতার রাস্তায় সে দেশের বিভিন্ন শ্রেণির লেখক, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যশিল্পী, সিনেমাজগতের মানুষরা টিনের বাক্স নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলতে বের হয়েছেন শরণার্থীদের জন্য। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলে তাতে সর্বাত্মক সাহায্য করেছে ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তান চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড সৃষ্টি হয় এবং আমাদের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে কত ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য কমপক্ষে ১৭ হাজার ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছেন। কিছু অর্বাচীনকে ইদানীং বলতে শুনি—বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না। তারা কি এই সব ইতিহাস জানে? বাংলাদেশ তো একজন ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানায়নি, জানিয়েছে আমাদের চরম দুর্দিনের প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। এই উপলক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করে গেলেন। এই অর্বাচীনরা জানে না ১৯৭১ সালে বাঙালি নিধনের পাকিস্তানের সব অস্ত্র এসেছে শ্রীলঙ্কা হয়ে। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ফ্লাইট বন্ধ ছিল। বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়াটা হতো চরম অসৌজন্যমূলক। চীনের প্রেসিডেন্টের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি এ উপলক্ষে একটি চমৎকার বাণী দিয়েছেন। চীন তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দেয়নি।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পারদের যে ওঠানামার কথা বলছিলাম, সেটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে উত্তর-পূর্ব ভারত ও স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা মিজোরাম স্বাধীন করার জন্য সেখানে পাকিস্তানের সহায়তায় শুরু হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সেই ষাটের দশকে। নেতৃত্বে লাল ডেঙ্গা। তার জন্য পাকিস্তান সরকার ঢাকার মতিঝিলে একটি অফিসও করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে, পাশে থেকে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে মিজোদের সব কার্যকলাপ বন্ধ করা হয়। ঠিক তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) বাংলাদেশ থেকে এসব অপতৎপরতা বন্ধ করা হয়, যা তার আগে খালেদা জিয়া সরকারের সময় আবার চালু হয়েছিল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে আবার এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের অপতৎপরতা শুরু করে। এবার একেবারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিষয়টা নিশ্চয় পাঠকদের মনে আছে। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের রাজ্যগুলো শান্ত। শেখ হাসিনা যখন বলেন তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন তা তারা চিরদিন মনে রাখবে, তখন সমালোচকরা চিৎকার শুরু করে—শেখ হাসিনা সব দিয়ে দিল। একটি দেশের নিরাপত্তার চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই হতে পারে না।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি পণ্যের চালানও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে গেছে। বাংলাদেশ তার একাধিক নৌবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে ভারতকে। কয়েকটি রেলপথ ও সড়কপথ খুলে দিয়েছে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যোগাযোগ যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই দুই দেশের জন্য মঙ্গল।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় থাকলে উভয় দেশ লাভবান হয়। তবে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারতের লাভ কিছুটা বেশি। কিন্তু দুই দেশের সুসম্পর্কের মাঝখানে দুটি বিষয় কাঁটার মতো বিঁধে আছে। একটি হচ্ছে তিস্তাসহ অভিন্ন সব নদীর পানিবণ্টনজনিত সমস্যা। গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার যদি সুরাহা হতে পারে, তাহলে অন্য নদীর পানিবণ্টন সমস্যার সুরাহা হতে কেন পারবে না? বাংলাদেশ ও ভারত তাদের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধান করেছে, যেমনটা করেছে ছিটমহলজনিত সমস্যার। অমীংমাসিত সমস্যার সমাধান নিহিত সদিচ্ছার ওপর। আর একটি সমস্যা হচ্ছে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মানুষ হত্যা। অবৈধ প্রবেশ ঠেকানোর অনেক পদ্ধতি আছে; হত্যা তার মধ্যে পড়ে না। এটিও একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা। রাজনৈতিক কারণে উভয় দেশেই কিছু মানুষ আছে, তারা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করতে তৎপর। এসব যত দ্রুত বন্ধ করা যায় ততই দুই দেশের জন্য মঙ্গল। বাংলাদেশ তার সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এটি বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তার জন্য সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। এতে লাভবান হবে সবাই। প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বের বিকল্প বন্ধুত্ব।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –