• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

প্রকাশ হয়েছে ‘মাদুলি’র তারেক মাসুদ সংখ্যা

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ৬ ডিসেম্বর ২০১৮  

প্রকাশ হয়েছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পত্রিকা ‘মাদুলি’র তারেক মাসুদ সংখ্যা। এর আগে বিনয় ‘মজুমদার’ ও ‘নিসর্গ’ শিরোনামে দু’টি সংখ্যা করে বেশ আলোচনায় আসে ‘মাদুলি’।

শুধু আলোচনা বিশেষণটি সংখ্যাটির ক্ষেত্রে খানিকটা কমই হয়; বলা যায়। তখন এটি নিয়ে রীতিমত হইচই পড়ে গিয়েছিল লিটলম্যাগ অঙ্গনে। চোখ কপালে তুললেন কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই। মফস্বল শহর থেকে এমন ঋদ্ধ একটি কাজ করায় মূলত এই আলোচনা। তবে দু’টি সংখ্যার মধ্যে সময়ের বেশ ফারাক ছিল। মোটামুটি বিরতির পর ‘নিসর্গ সংখ্যা’ নামে এটিও বেশ আলোচিত হলো। লিটলম্যাগ অঙ্গনে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ‘মাদুলি’ মানেই একটি ভিন্ন রকম প্রয়াস। বিরতি দিয়ে হলেও পূর্ণতা নিয়েই পাঠকের সামনে হাজির হয়। এরপর থেকে লিটলম্যাগ বোদ্ধারাসহ আমার মতো সাধারণ পাঠকও অপেক্ষা করতে থাকল ‘মাদুলি’র জন্য। যেন আষাঢ়ের বৃষ্টির অপেক্ষায় কৃষক। কিন্তু সম্পাদকের সুমতি মেলে না। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও ‘মাদুলি’র দেখা নেই। তবুও মনের কোণে আশা জিইয়ে রাখি, নিশ্চয়ই ভালো কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবে ‘মাদুলি’। শেষে পূর্ণও হলো।

স্বাধীন চলচ্চিত্রের অন্যতম রূপকার অকাল প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদকে নিয়ে সংখ্যাটি বের হলো ২০১৭ সালে। পূর্ণ হলো পাঠকের চাওয়া। আদতে পূর্ণ হলো ‘মাদুলি’। ৫৭৮ পৃষ্ঠার বৃহৎ এ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে আটটি পর্বে। ‘তারেক মাসুদ ও তার চলচ্চিত্র’ নামে সাজানো প্রথম পর্বে মুক্তগদ্য লিখেছেন তারেক মাসুদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ, প্রাবন্ধিক অনুপম হায়াৎ, সাজেদুল আউয়াল, সলিমুল্লাহ খান, জুনায়েদ হালিম, আলম খোরশেদ, আহমাদ মাযহার, ইকবাল করিম হাসনু, সাদ কামালী, সুমন রহমান, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, মনিস রফিক, প্রসূন রহমান, দ্রাবিড় সৈকত, কাজী মামুন হায়দার, জাহেদ সরওয়ার, শৈবাল চৌধূরী, রুবাইয়াৎ আহমেদ, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ড. নাদির জুনাইদ, রফিকুল আনোয়ার রাসেল, বেলায়েত হোসেন মামুন, আবদুল্লাহ আল আমিন, উদিসা ইসলাম, মাসুদ পারভেজ, এসএম ইমরান হোসেন, প্রণব ভৌমিক ও তুষার চন্দন। এ পর্বের শেষের দিকে তারেক মাসুদের নির্মিত সিনেমা ‘মুক্তির গান’ নিয়ে আলোচনা করেছেন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক জাকির হোসেন রাজু, সুশীল সাহা, প্রফেসর আলতাফ হোসেন, আকতার হোসেন ও হামিম কামাল। ‘মুক্তির কথা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন শাহাদুজ্জামান।

লাবিব নাজমুছ ছাকিব লিখেছেন ‘নারীর কথা’ নিয়ে। তারেক মাসুদের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিনেমা ‘মাটির ময়না’ নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ফৌজিয়া খান ও রিফাত হাসান। আলোচনায় বাদ যায়নি ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘নরসুন্দর’, ‘রানওয়ে’ সিনেমাগুলোও। পরবর্তী পর্বগুলোয় তারেক মাসুদের গান, চিত্রনাট্য, গ্রন্থ ও প্রবন্ধ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সংখ্যাটিতে রয়েছে তারেক মাসুদের সাক্ষাৎকার পর্যালোচনা। এ পর্বে লিখেছেন ফাহমিদুল হক, পরিতোষ হালদার ও মনি হায়দার। তারেক মাসুদকে নিয়ে স্মৃতি এঁকেছেন ঢালী আল মামুন, মোরশেদুল ইসলাম, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, বাবলু ভাট্টাচার্য, রোকেয়া প্রাচী, স্বকৃত নোমান, সুগত সিংহ, মফিজ ইমাম মিলন, সালমা রহমান, শিপ্রা গোস্বামী, হাবিবুর রহমান মাসুদ বাবু ও সম্পা মাসুদ। এই হলো ‘মাদুলি’র তারেক মাসুদ সংখ্যার মোটামুটি পরিচিতি। এবার কিছুটা আলোচনা করা যাক। শিরোনাম ধরে যদি আলোচনায় আসি তাহলে প্রথমেই বলি তারেক মাসুদ তো পূর্ণ হয়েছেন তার কর্মগুণেই। পূর্ণ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রকে। আর তাকে নিয়ে সংখ্যা করায় পূর্ণতা দিয়েছেন মাদুলিকে। সংখ্যাটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তারেক মাসুদের আদ্যপান্ত তুলে এনেছেন সম্পাদক। বাদ যায়নি তার পারিবারিক বিষয়াদিও। রুবাইয়াৎ আহমেদ ‘তারেক মাসুদের জীবন ও কর্ম’ শিরোনামের লেখাটিতে উল্লেখ করেছেন বাবার ভেতর আকস্মিক পরিবর্তন নিয়ে তারেক মাসুদের বক্তব্য। এ বিষয়ে তারেক মাসুদ উল্লেখ করেছিলেন ‘হঠাৎ করে আমার নানি মারা যাবার পর প্রথম কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অ্যাডাল্ট বয়সে আমার বাবাকে দেখা যায়। জানাজার পরই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরো একটা বিরাট বাড়ি যেখানে অল্প বয়সের আমাকে নিয়ে আমার মা পুরো একা। আমার বাবা যে হারিয়ে গেলেন এরপর কয়েক মাস পর আলখাল্লা পরা লম্বা দাড়িওয়ালা অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসেন।’ এ অংশের পর লেখক বলেছেন, ‘পিতার এই ধর্মপন্থার কারণে তারেক ও তার মায়ের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের ধর্মীয় বিধিনিষেধ। বাড়িতে পর্দা প্রথার প্রচলনসহ তারেকের বাবার ইচ্ছে জাগে তাকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। এ কারণেই তারেককে ভর্তি করে দিলেন মাদ্রাসায়। জীবনের প্রথম মাদ্রাসা দর্শনের বর্ণনায় তারেক বলেন আমার প্রথম ভর্তি হওয়া ভাঙ্গা মাদ্রাসাসংলগ্ন একটি বিরাট দীঘি ছিল। যেটি আমরা ব্যবহার করতাম। আমি যখন প্রথম মাদ্রাসায় গেলাম সেদিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমাকে তুলে সেই বিরাট দীঘির ঘাটে নিয়ে যাওয়া হলো। কুয়াশার ভেতর সামান্য আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল সবাই মেসওয়াক করছে। আমাকেও মেসওয়াক করা শেখানো হলো। আসলে একটি শিশুর ওই ধরনের অভিজ্ঞতা একরকম ইন্দ্রজালিক অভিজ্ঞতা।’ উল্লেখিত অংশ পাঠের পর নিশ্চয়ই কোনো পাঠকের বুঝতে বাকি থাকবে না-পারিবারিক চাপে শুরু হওয়া মাদ্রাসাজীবন তারেক মাসুদের জন্য নিশ্চয়ই সুখকর ছিল না। সেই জীবন পাড়ি দিয়ে একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠাও সহজ বিষয় ছিল না। যা তারেক মাসুদ তার ‘মাটির ময়না’ সিনেমার মাধ্যমে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছেন।

মাটির ময়না নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এর প্রধান চরিত্র আনুর বিষয়ে ফৌজিয়া খান লিখেছেন, ‘এ দেশের জনমানুষের এক বৃহৎ অংশের জীবনবাস্তবতা রূপায়ণে পরিচালক বাহন করেছেন আনুকে। বর্ণনাত্মক রীতিতে এগিয়ে যাওয়া আনুর জীবনকাহিনিতে পরিচালক থেকে থেকেই বাহাস তথা নানা তর্ক-বিতর্কের আশ্রয় নিয়েছেন। সে বিতর্ক মানুষে মানুষে মতের বিতর্ক। আনুর পরিবাওে ওর মা আয়েশা আর বাবা কাজী সাহেবের চাপা বিরোধ। সে বিরোধ মতের, সে বিরোধ পথের। আয়েশা চান ধর্মীয় ক‚পমণ্ডূকতার বাইরে মুক্ত হাওয়ায় দম ফেলতে, মুক্ত জলে সন্তরণ করতে। কিন্তু ধর্মঠহৃদয় কাজী সাহেব ধর্মের লেবাসকেই মুখ্য করেছেন। তিনি চান মুক্ত হাওয়া বন্ধ করতে।’ ফৌজিয়া খান বলেছেন, মাটির ময়নায় আয়েশা আর কাজী সাহেবের দ্বন্দ্ব তথা সিনেমার মূল বিষয়ে নিয়ে যায় আমাদের। ‘মাটির ময়না’র বিষয় তো খোলা মত ও অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। আর সেটি দেখাতে গিয়ে নির্মাতার অবলম্বন আনুর পরিবার ও তার মাদ্রাসাজীবন তাকে সফলতার পথে বেশ খানিকটা এগিয়ে দেয়।’

আলোচনার এ পর্যায়ে তারেক মাসুদের জীবনযুদ্ধের চিত্র নিশ্চয়ই বাকি নেই। তারেক মাসুদ নিজেও একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমি হয়তো মসজিদের ইমাম হতাম। মুক্তিযুদ্ধেও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারেক মাসুদ বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। সেই চলচ্চিত্র নির্মাণেও আসলে আমি জাতির কাছে ঋণী। শুধু একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে নয়; একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও। মুক্তিযুদ্ধের জন্যই আমি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। একাত্তর সাল পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। যুদ্ধ শেষ হবার পর বাবা বললেন, তুমি মাদ্রাসায় আর ফিরে যাবে না। তুমি পরীক্ষা দেবে প্রাইভেট কিংবা সাধারণ থেকে। আমার চাচা এবং চাচাতো ভাইবোনসহ নিকট আত্মীয়ের আন্তরিক উৎসাহে গ্রামের ছেলে ঢাকায় আসি এবং ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্টে পড়ার সুযোগ পাই। মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছে।

তারেক মাসুদের একটি সাক্ষাৎকারের ভূমিকায় রুদ্র আরিফ লিখেছেন, ‘চলচ্চিত্রকার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একজন তরুণ নিজেকে কিভাবে তৈরি করবে এমন জিজ্ঞাসা নির্দিষ্ট করেই তার কাছে যাওয়া। অর্থাৎ, তারেকের যে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্মাণ করতে হয়েছে তা সর্বজন স্বীকৃত। সর্বজন জ্ঞাত। এই সাক্ষাৎকারে ‘আপনি নিজে কিভাবে চলচ্চিত্রে এলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক মাসুদ বলেছেন, ‘আমি আসলে সচেতনভাবে নির্মাতা হইনি। আমি যখন ছবি বানাচ্ছি, তখনো বুঝতে পারিনি নির্মাতা হচ্ছি। কারণ আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সে পরিবেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ তো দূরের কথা, চলচ্চিত্র দেখাও প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে কখনো ভাবিনি নির্মাতা হব। এখনকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু ভাবতে পারে, বড় হয়ে আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হব। আমার বন্ধুবান্ধবের ছেলেমেয়েকে এরকম বলতে শুনি। এটা আসলে এখন প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। ’

মাদুলির এ সংখ্যায় তারেক মাসুদের নিজের বক্তব্যে, পরিবারের লোকজনের কথায়, নিকটজনের স্মৃতিচারণসহ সমসাময়িক গুণী লেখকদের কলমের আঁচড়ে চিত্রিত হয়েছে পুরো তারেক মাসুদ। সংখ্যাটি দীর্ঘ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে মনে হয়েছে তারেক মাসুদের পূর্ণ জীবন নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সংখ্যাটিতে রয়েছে তার স্বল্প জীবনের বিশাল অর্জনের নেপথ্য কথা। আছে নূরপুর গ্রামের ধর্মভীরু একটি পরিবার থেকে বেরিয়ে একজ চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠার গল্প। তারুণ্যের পথদির্নেশক হওয়ার গল্প। তারেক মাসুদের অর্জনের তুলনায় ৫৭৮ পৃষ্ঠা নেহায়েতই কম। এই অল্প জায়গার মধ্যে তারেক মাসুদের সব দিক তুলে ধরা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। এজন্য সম্পাদক, লেখকসহ ‘মাদুলি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের প্রতি অশেষ ভালোবাসা। দিদারুল লিমনের আঁকা পোট্রেট অবলম্বনে পত্রিকাটির প্রচ্ছদ করেছেন সিপাহী রেজা। মূল্য ৩০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে আজিজ সুপার মার্কেট ও কনকর্ড এম্পোরিয়ামসহ দেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকানগুলোয়।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –