• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮  

মারমা সমাজে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আদিবাসী গোষ্ঠীর রেওয়াজ অনুসারে মামাত-ফুফাত ভাইবোনের মধ্যেই বিবাহ প্রথা প্রচলিত।এ সমাজে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ হলেও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়।পাত্রপক্ষের প্রস্তাব ও কনেপক্ষের সম্মতিতে মারমারা সামাজিকভাবে বিবাহ প্রথা সম্পন্ন করে। পাত্রপক্ষের উদ্যোগেই এই পর্ব শুরু হয়। পাত্রপক্ষের পরিচিত ও বিশ্বস্ত ব্যাক্তি কিংবা নিকট অথবা দূরসম্পর্কীয় কোনো আত্নীয় পাত্রীপক্ষের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পৌঁছে দেন।পাত্রীপক্ষের অভিভাবকের ‘হ্যাঁ’ সূচক সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রের পিতা-মাতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব অথবা গুরুজনরা বেজোড় সংখ্যক ব্যাক্তি ও এক বোতল মদ, ২৫টি সুপারি, ১ বিড়া পান, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, চিনি, আঁখ, ১ জোড়া নারিকেল নিয়ে পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে যান।সেখানে তারা একবোতল মদ পাত্রীর মা-বাবাকে উপহার দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব প্রদান করেন। পাত্রীর মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেয়া হয়। মেয়ের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রপক্ষের দেয়া মদের বোতল পাত্রীপক্ষ গ্রহণ করে অনুরুপ আর এক বোতল মদ পাত্রীর পরিবার থেকে পাত্রপক্ষকে দেয়া হয়।এসময় উভয়পক্ষের হাসি-ঠাট্রায় মদ পানসহ বিয়ের কথাবার্তা পাকা করা হয়।এ পর্যায়ে একজন জ্যোতিষি এনে পাত্র-পাত্রীর রাশি গণণা ও বিয়ের শুভলগ্ন দেখা হয়। সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে পাত্রী পাত্রপক্ষের গুরুজনদের প্রণাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করে। এসময় পাত্রপক্ষ একটি থামী, রুপা বা স্বর্ণের একটি আংটি দিয়ে পাত্রীকে আর্শীবাদ করেন।

 

1.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাত্রীর বাড়ির প্রবেশ দ্বারে কলাগাছের দুটি কচি চারা বসিয়ে তার পাশে ‘রিজারও’ (সাদা সূতো দিয়ে পেঁচানো দু’টো পানি পূর্ণ কলস)এবং সিফাইক (বিভিন্ন চাল থেকে তৈরি পানীয় রাখা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে পাত্রের বাবা নিজ বাড়িতে গৃহ দেবতার উদ্দেশ্যে ‘চুং –মং-লে ’ পূজার আয়োজন করে।এ পূজায় দেবতার উদ্দেশ্যে একটি শুকুর ও পাঁচটি মুরগি বলি দেয়া হয়। বউ আনতে যাবার দিন একটি সেদ্ধ মোরগ, চিংরে (মদ তৈরি হবার পূর্বে ভাত, পানি ও মুলির সংমিশ্রন) এক বোতল, এক বোতল মদ, একটি থবিং (মারমা মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়), একটি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোশাক), একটি রাংগাই আংগি (বক্ষবন্ধনী), এক জোড়া কাখ্যাং (পায়ের খারু),একটি গবং (মাথার বন্ধনী), নিয়ে পাত্রের মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধবসহ বাদ্য-বাজনা সহকারে কনের পিত্রালয়ে যান। তবে বিবাহের মূল অনুষ্ঠানটি ‘উবদিদাই’ বা মতে ছরা (বিবাহের মন্ত্র জানা ব্যাক্তি) দ্বারা বরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রপূত জলপূর্ণ পাত্রে এক গুচ্ছ জামের কচি পাতা ডুবিয়ে তা দিয়ে বর ও কনের মাথায় পাঁচ-সাতবার পবিত্র জল ছিঁটিয়ে দেন।বিয়ের অনুষ্ঠানের মূল পর্বে কনের ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের সঙ্গে বরের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি যুক্ত করে তাতে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানকে মারমা ভাষায় ‘লাক্ থেক পোই বলে।‘লাক্ থেক পোই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করা হয়।

 

2.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী ‘উবদিদাই’ এমন একজন ব্যাক্তিকে হতে হবে ‘যিনি বিপত্নীক বা বিচ্ছেদ প্রাপ্ত নন। বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে আর্শীবাদের সময় ‘উবদিদাই’ তার হাতে থাকা একটি তলোয়ার এর মধ্যে পাঁচ প্যাঁচে পেঁচানো সুতার কুণ্ডলী তলোয়ার থেকে ব্যবধান না রেখে কনের মনিবন্ধে পরিয়ে দেয়। কনে বরকে প্রণাম করে তা গ্রহণ করে। একটি মোরগ বধ করে আস্ত সেদ্ধ করার পর ‘উবদিদাই’ বা ‘মতে ছরা’ সেই মোরগের জিহ্বার অংশ টেনে প্রথমে বর ও কনের মা-বাবাকে এরপর ক্রমান্বয়ে উপস্থিত সকলকে দেখান।‘চাইংগা’ বা জিহ্বা যদি বাম দিকে হেলে থাকে তাহলে মনে করা হয়, বর যদি কনের আত্নীয়স্বজনদের সঙ্গে মিলেমিশে জীবিকা নির্বাহ করে, তাহলে সর্বাধিক উন্নতি করবে এবং ডানদিকে হেলে থাকলে উল্টো ফল হবে।এবার সেদ্ধ মোরগটিকে প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে খাওয়ার উপযোগী করে বর-কনের জন্য একটি পাত্রে পরিবেশন করা হয়। বর ও কনে একত্রে এক পাত্রে খাওয়ায় এই অনুষ্ঠানকে ‘লাক ছং চা-চ’ বলা হয়। মারমা সমাজসিদ্ধ বিবাহে ‘লাক ছং চা-চ’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা অপরিহার্য। এ অনুষ্ঠানের পর থেকে তারা দু’জনে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে। বিয়ের এই সামাজিক আনুষ্ঠানিকতাকে ‘মেয়াপই বলে। বিবাহ অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পঞ্চশীল গ্রহন এবং মঙ্গল সূত্র পাঠসহ পিন্ড দান ইত্যাদি ধর্মীয় আচার পালনের রীতি সম্প্রতি মারমা সমাজে প্রসারলাভ করেছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে মদ পরিবেশন, চাইংগা, চুংমংলে এসব আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করা হয়। এসবের পরিবর্তে ফুল, খৈ, মিষ্টান্ন জাতীয় দ্রব্যাদি দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।

 

3.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

খাজনা আদায় ও বিচার সালিশ

রাজপূন্যাহ মূলত হচ্ছে সার্কেল চিফের তথা রাজার বাৎসরিক খাজনা আদায় উৎসব যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পইংজ্রা। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম বোমাং রাজা সাক হ্ন ঞো প্রথম রাজপূণ্যাহর আয়োজন করেন। পাহাড়ে জুম উঠে যাওয়ার পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে জুম চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয়। এ সময় রাজার পক্ষ হতে রাজপূন্যাহর আয়োজন করা হয়ে থাকে। রাজা এক ধরনের মেলার/উৎসবের আয়োজন করেন যেখানে প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য থাকে যাত্রা, সার্কাস, বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট নাচ-গান-নাটক, ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রীর মেলাসহ নানা রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এ উৎসবকে ঘিরে রাজবাড়ীতে সাজ সাজ রব শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। রাজকীয় সাজসজ্জা আর বিউগলের সুরে মুখরিত থাকে রাজপুণ্যাহর দিনগুলো। রাজা রাজ পোশাক পরে এবং গার্ড অব অর্নার গ্রহনের মাধ্যমে রাজবাড়ী থেকে সৈন্য-সেনা সহ মঞ্চে আসেন। বিভিন্ন মৌজার হেডম্যান-কারবারীগণ রাজপুণ্যাহ তে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ট্যাক্স রাজার হাতে তুলে দেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী প্রতিটি জুমিয়া পরিবারকে জুম ট্যাক্স হিসেবে এক বছরের জন্য ৬ টাকা করে প্রদান করতে হয়। এই ৬ টাকা হতে বোমাং রাজা আড়াই টাকা গ্রহন করেন, হেডম্যান গ্রহন করে ২ টাকা ২৫ পয়সা এবং বাকী টাকা চলে যায় সরকারি রাজস্বে। আধুনিক যুগে ফিকে হয়ে আসা এই রাজতন্ত্রের রাজাদের মূলত ট্যাক্স আদায় আর বিচার-শালিস ছাড়া তাদের রাজত্বে তেমন কোন ভূমিকা নেই।

 

4.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী এই রাজাকে 'সার্কেল চিফ' হিসেবে জেলার ডেপুটি কমিশনারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন তথা সাব-কালেক্টর বা সরকারের খাজনা আদায়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাজনা আদায় ও এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ অপরাধ দমনে মৌজা হেডম্যানদের প্রতি আদেশ- নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান, আদায়কৃত খাজনা সরকারি কোষাগারে জমাদান নিশ্চিত করেন, এলাকার জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার, নিজ সার্কেলের অধীন মৌজাসমূহে ডেপুটি কমিশনারের আদেশ নির্দেশ কার্যকরীকরণ ইত্যাদি কর্মকান্ড তাকে পালন করতে হয়। ১৮৯২ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। যেখানে ৩৩টি তালুককে দেড় থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মৌজায় বিভক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে (হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল) তিনজন রাজার ৩টি সার্কেলকে মৌজায় বিভক্ত করার পুনঃবিধান করা হয় এবং প্রত্যেক মৌজায় ১ জন করে মৌজা হেডম্যান নিয়োগের বিধান রাখা হয়। এই বিধি মতে, সার্কেল চীফের (রাজা) সঙ্গে পরামর্শ করে ডেপুটি কমিশনার মৌজা হেডম্যান নিয়োগ করেন। সার্কেল চীফ তথা রাজার মত হেডম্যান নামক এই পদটি বংশানুক্রমিক নয় তবে হেডম্যানের উপযুক্ত পুত্র হেডম্যান পদে নিয়োগ লাভের বেলায় অগ্রাধিকারের দাবী রাখেন।

 

5.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

উক্ত বিধি অনুযায়ী একজন হেডম্যান তার মৌজায় নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন-

১। জুমিয়া জমির মালিকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়

২।ডেপুটি কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সার্কেল চীফের আদেশ মেনে চলা

৩। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা

৪। মৌজায় চাষাবাদের আওতাধীন এলাকার (আয়তনের) কোনো পরিবর্তন ঘটলে তৎসম্পর্কে ডেপুটি কমিশনারকে অবহিত করা

৫। জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ করা

৬। জুম তৌজি তথা জুমিয়ার তালিকা প্রস্তুত করা

৭। জুম খাজনা প্রদান থেকে রেহাই পাবার জন্য অন্যত্র পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়া প্রজার সম্পত্তি আটক

৮। মৌজার প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষন

৯। সরকারী ভূমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, ভাগ-বন্টন এবং পুনঃ ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদান

উপরোক্ত দায়িত্ব ছাড়াও উক্ত বিধি হেডম্যানকে কিছু বিচারিক ক্ষমতাও প্রদান করে। এবং একটা বিচারকার্যে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন ও দোষী ব্যাক্তিকে ৫০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন এছাড়া জেলা প্রশাসকের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিকে আটক রাখবার আদেশ দিতে পারবেন। একজন হেডম্যানের উপরে বর্ণিত বিচারিক ক্ষমতা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে, হেডম্যানগণ বিচার কার্য নামক বিষয়টিকে এড়িয়েই চলেন। এই কাজগুলো তথা বিচার, মীমাংসা, সালিশ, গোত্র/পাড়া পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি কারবারীদের হাতে ন্যস্ত হয়ে গেছে। গঠিত হয়েছে কারবারী আদালত।

 

6.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

মারমা সম্প্রদায়ে কারবারী বলতে মূলত গ্রাম প্রধান তথা মারমাদের স্থানীয় চিফকে বোঝায়। ফ্রান্সিস বুকানন তার ভ্রমণ ডাইরীতে এই কারবারীকে, রুয়া-সা তথা মারমাদের স্থানীয় চীফ, যার বর্মী নাম য়্য-সা, আরাকানী নাম য়্যন্সা এবং বাংলায় বিকৃত শব্দ রোয়াজা বলে উল্লেখ করেন। কারবারী নামক এই গ্রাম প্রধানের অস্তিত্বের কথা সর্ব প্রথম উঠে আসে নতুন সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনটেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন জে.এম. গ্রাহামের ১৮ই নভেম্বর, ১৮৬২ তারিখের এক পত্রে। আবার ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লুইনের ১৮৬৭ সালের অন্য আরেকটি প্রতিবেদনেও এই কারবারী নামটি উঠে আসে। সুদূর অতীতে পাড়াগুলোতে রাজারা, এই রোয়াজা তথা কারবারী নিয়োগ দিতেন এবং সে সময় এই রোয়াজারাই ছিলেন গ্রাম প্রধান। তিনি রাজার হয়ে, প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করতেন। প্রজাদের সকল ধরনের বিচার-আচার, ভাল-মন্দ, দুঃখ-দূর্দশা, শাস্তি-বিধান, আইন-কানুন, ধর্ম-আচার সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ছিল তার হাতে। কিন্তু কালের আবর্তে রাজাদের সঙ্গে সঙ্গে এই কারবারীদের ক্ষমতাও কমে যেতে শুরু করে। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিতে কারবারী নিয়োগ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোনো বিবরণ না থাকলেও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৬৬(১) ধারাতে কারবারী পদের স্বীকৃতি রয়েছে। পার্বত্য জেলাসমূহের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা, নারীঘটিত কোনো সামাজিক মোকদ্দমার উদ্ভব হলে তা নিষ্পত্তির প্রাথমিক দায়িত্ব কারবারীর উপর বর্তায়।

 

7.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

প্রথম দিকে, ব্রিটিশ পিরিয়ডে কারবারীরা সরকার হতে কোনো ধরনের ভাতা না পেলেও বর্তমানে তারা সরকার হতে ভাতা পান। যদিও কারবারী নিয়োগের নিয়ম হল, পাড়াগুলোতে রাজা অথবা হেডম্যান এই কারবারী নিয়োগ দেবেন কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এই পদটি হয়ে উঠেছে বংশানুক্রমিক। অর্থ্যাৎ কারবারীর বড় ছেলেই হয়ে উঠেন কারবারী। এরা গ্রাম তথা পাড়ার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করেন কারবারী আদালতে। এছাড়াও পাড়ার পূজা-অর্চনা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আদেশ- পরামর্শ প্রদান করেন। কারবারী আদালতে বিচার প্রক্রিয়া হয় মূলত সালিসী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে। যেই বোর্ডে অন্য দুই বা তিন পাড়ার কারবারীরা উপস্থিত থাকেন, মাঝে মাঝে হেডম্যান অথবা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (বাধ্যতামূলক নয়) উপস্থিত থাকেন এবং গ্রামের কিছু গণ্যমান্য পুরুষ, মহিলা এবং যুবক, যুবতী অংশগ্রহণ করেন। বাদী এবং বিবাদী উভয়ই উপস্থিত থাকেন। বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শোনা হয়, স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য যে রায় দেন তাই ঘোষণা করেন কারবারী। কারবারী আদালতে বিচার/সালিস/ মিমাংসা শুরুর আগে একটা সাদা কাগজে বাদী, বিবাদী/অভিযুক্তের এই মর্মে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়া হয় যে, বিচারে যেই রায় ই ঘোষনা করা হোক না কেন তা তারা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য থাকিবে। পরবর্তীতে আবার এই কাগজেই বিচারের ফলাফল লেখা হয়।

 

8.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

প্রমাণ হিসেবে কারবারী এই কাগজটি তার নিকট সংরক্ষণ করেন। বিচার-শালিসের ইস্যু যদি খুব বেশি জটিল হয় অথবা পাড়ার কেউ যদি কারবারী আদালতের সিদ্ধান্তকে মেনে না নিতে চায় তবে সে ইউনিয়ন পরিষদের স্মরণাপন্ন হতে পারে। পাড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকা তথা কোনো ধরনের অশান্তি, উত্তেজনা, বিবাদ-কলহের সৃষ্টি না হওয়ার জন্য কারবারী তার গ্রামের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে তৈরি করেন পাড়ার চমৎকার কিছু নিয়ম নীতি, আইন কানুন। এসব নিয়ম কানুনের মধ্যে একটা হল নিষেধাজ্ঞা। রাত ৮ টার পর হতে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোন দম্পতি কোনো ধরনের ঝগড়া কলহে লিপ্ত হতে পারবে না। হলে তাদেরকে কারবারী আদালতে তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসা হবে এবং পূর্ব নির্ধারিত শাস্তি হল ছোট্ট একটা চা চামচ দিয়ে কূপ হতে এক চামচ করে পানি নিয়ে এসে একটা খালি কলস ভর্তি করা, অথবা ছোট একটা কলসীতে এক কলস করে পানি কূপ হতে নিয়ে পাহাড়ের উপরে মন্দিরে রাখা বড় একটা জার ভর্তি করা। এসব নিয়ম কানুন ছাড়াও রয়েছে মদ খেয়ে মাতলামী না করার নিয়ম কানুন, পাড়ায় যুব কমিটি তৈরি করে তাদের দিয়ে পাড়ার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ পরিচালনা এবং অন্য যুবক-যুবতীদের আইন শেখানো ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

9.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

চাষাবাদ

মারমারা খুবই পরিশ্রমী। কৃষিই মারমা উপজাতিদের প্রধান পেশা। এরা জুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। জুম চাষ পাহাড়ি এলাকায় প্রচলিত এক ধরনের কৃষিপদ্ধতি। 'জুম চাষ' বিশেষ শব্দে 'ঝুম চাষ' নামেও পরিচিত। এটি এক ধরনের স্থানান্তরিত কৃষিপদ্ধতি যা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল কেটে কয়েক মাস তা রোদে শুকানো হয়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শুকনো জঙ্গলগুলো পুড়িয়ে জুম চাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করা হয়।

 

10.ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী: মারমাদের আদ্যোপান্ত (শেষ পর্ব)

খাদ্য আদিবাসী মারমা সম্প্রদায়ে আঠালো ভাতের সঙ্গে ‘নাপ্পি’ (শুটকি) খাওয়া হয়। কখনো কখনো তাদের আহারে ভাতের সঙ্গে ‘লাসৌ’ও (বিভিন্ন মিশ্রণের ভর্তা) থাকে। এছাড়া তারা বিন্নি চালের সঙ্গে নারিকেল ও চিনি যোগ করে স্যুপের মতো আঠালো করে এক প্রকার খাদ্য খেতেও পছন্দ করে। ‘সাংগ্রাই’ উত্সবে মারমারা বিভিন্নি সবজি ও শুটকি দিয়ে ‘হাংরো’ তৈরি করে, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। মারমাদের অন্যতম পছন্দের আরেকটি খাবার হচ্ছে কচি বাঁশ সিদ্ধ, যা সবজি হিসেবে ব্যবহূত হয়। স্থানীয়ভাবে এটি বাঁশকড়ল নামে পরিচিত। মারমারা বিকেলের নাস্তায় ‘মুন্ডি’র আয়োজন করে। মুন্ডি দেখতে অনেকটা নুডলসের মতো, যার ওপরে শুটকির গুড়ো ও গরম পানি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –