• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

করোনাকালে করজে হাসানার গুরুত্ব ও ফযিলত

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২০  

বর্তমান করোনার এই সময়ে নিজেদেরকে সংশোধনের জন্য ধর্ম পালন ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। সমাজের বিধবা, এতিম ও অসহায়ের প্রতি বিত্তবানেরা হাত বাড়িয়েছে। অন্যদিকে সুদি লেনদেনও মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুদের প্রতি মানুষের মন থেকে ঘৃণা ওঠে যাচ্ছে। অথচ বিপদ থেকে মুক্তি পেতে ধর্মীয় বিধিবিধান নামাজ, রোজা ইত্যাদি পালন যেমন জরুরি, তদ্রুপ অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধিও জরুরি।

হাদিসে এসেছে, এক লোক দ্বীনের পথে লম্বা লম্বা সফরে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তারপরও তার দোয়া কবুল হয় না। আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, আমি কীভাবে তার দোয়া কবুল করবো? তার পানাহার, পোশাক সবই হারাম মাল দিয়ে তৈরি।’ (মেশকাত, হাদিস নম্বর: ২৭৬০)।

সমাজে একটা শ্রেণি আছে, মানুষের দান-অনুদান নিতে যাদের আত্মমর্যাদায় লাগে। তাদের সমস্যা সাময়িক। পরিবেশ স্বাভাবিক হলে তাদের অভাব দূর হয়ে যাবে। এখন তারা চায় কিছু অর্থের জোগান। যা দিয়ে করোনার এই সময়ে পরিবার নিয়ে চলবে। সমাজে ইসলামি শিক্ষার প্রতিফলন ঘটলে, এ ধরনের পরিস্থিতে একে অপরকে করজে হাসানা দিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে মজবুত করতো। করজে হাসানা হচ্ছে ওই ঋণ, যা দিয়ে ঋণী ব্যক্তি থেকে কোনরূপ ফায়দা বা অতিরিক্ত অর্থ নেয়া হয় না। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক চাপ কমে। কিন্তু আমাদের পুরো অর্থব্যবস্থা আজ সুদের ওপর ভাসছে। মনুষ্যত্ববোধ লোপ পাচ্ছে। সামর্থ্য থাকা সত্তেও সুদ ছাড়া কেউ কাউকে ঋণ দিতে রাজি হচ্ছে না। অথচ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দান-সদকার চেয়েও সুদবিহীন ঋণের ফজিলত বেশি।

কোরআন ও  হাদিসে করজে হাসানা বা সুদ বিহীন ঋণের আলোচনা পাওয়া যায়। সেখানে করজে হাসানার ফজিলত ও বিভিন্ন বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে। মুসলিম দেশ হিসেবে করোনার এই সময়ে করজে হাসানার প্রচলন ঘটাতে আমাদের সরকারও উদ্যোগ নিতে পারে। ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি করজে হাসানার জন্যও সামাজিকভাবে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে মানুষের মাঝে সামাজিক বন্ধন মজবুত হবে। স্থাপন হবে সহানুভূতি ও সহযোগিতার অনন্য দৃষ্টান্ত। নিম্নে কোরআন ও হাদিসের আলোকে করজে হাসানার অবস্থান ও তাতে বর্ণিত বিধিবিধান তুলে ধরা হলো।

আল কোরআনে করজে হাসানা:

করজে হাসানার গুরুত্ব বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এই লেনদেনকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে লেনদেন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যদিও বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে করজ দেয়া হচ্ছে। আল কোরআনে এসেছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে করজে হাসানা দাও তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ তায়ালা খুবই গ্রণগ্রাহী, ধৈর্যশীল।’ (সূরা: তাগাবুন, আয়াত: ১৭)। আয়াতটি থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝে আসে-

(এক) করজে হাসানা দেয়ার দ্বারা সম্পদের মধ্যে বরকত হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, করজে হাসানা দেয়ার দ্বারা সাত থেকে সত্তর গুণ পর্যন্ত সম্পদে বরকত হয়। এর বিপরীত হচ্ছে সুদ। এর দ্বারা মাল ধ্বংস হয়ে যায়। তারপরও সবাই সুদ ভিত্তিক ঋণের দিকে যাচ্ছি। সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বৃদ্ধি করেন। আর আল্লাহ তায়ালা কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত নম্বর: ২৭৬)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়, কোনো হালাল মালের সঙ্গে হারাম মাল মিশ্রিত হলে, ওই হালাল মালও ধ্বংস হয়ে যায়।

(দুই) করজে হাসানা দ্বারা গুনাহ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়া হয়। কোনো কারণে বা অকারণে বিপদাপদ দেখা দিলে আমরা দান সদকা করি। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, করজে হাসানা দ্বারাও আল্লাহ তায়ালা গুনাহকে ক্ষমা করে থাকেন এবং বিপদাপদ দূর করেন। অন্যদিকে সুদি ঋণের কারণে আল্লাহ তায়ালা নারাজ হন। যারা সুদি ঋণ না ছাড়ে, আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলের পক্ষ থেকে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা সুদ ভিত্তিক ঋণ না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সংবাদ জেনে নাও। তোমরা কারো ওপর জুলুম করবে না এবং তোমাদেরও ওপর জুলুম করা হবে না।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত নম্বর: ২৭৯)। সুদ মূলত ঋণী ব্যক্তির ওপর এক ধরনের জুলুম, যে কারণে সুদগ্রহীতার ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসে। তাই আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তোমরা জুলুম করবে না। তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের ওপর কোনো আজাব-গজব বা কোনো জালিমের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা করা হবে না।

সূরা বাকারা ২৪৫ নম্বর আয়াতে করজে হাসানা সম্পর্কে এসেছে, ‘কে আছে এমন, যে আল্লাহকে করজে হাসানা দেবে, তারপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন? আল্লাহই রিজিক সঙ্কুচিত করেন ও প্রসারিত করেন।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৪৫) অনেকে মনে করতে পারেন, টাকা দিয়ে টাকা না আসলে লাভ কী? আল্লাহ তায়ালা এর উত্তর দিয়ে দিয়েছেন যে, রিজিক সঙ্কুচিত করা বা বৃদ্ধি করার মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি চাইলে কোনো মাধ্যম ছাড়াই কারো রিজিক বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। চাইলে ব্যক্তির শত চেষ্টাও তার রিজিক সঙ্কুচিত করে দিতে পারেন। তাই তার নির্দেশনা মেনে চলার মাঝেই কামিয়াবি।

করজে হাসানা অসহায়ের ওপর ইহসান:

করজে হাসানাকে শুধু আর্থিক লেনদেন হিসেবে দেখলে হবে না। করজে হাসানা হচ্ছে, অসহায় মানুষের ওপর ইহসান। কেউ কারো ওপর ইহসান করলে, সারা জীবনের জন্য সে ঋণী হয়ে যায়। প্রবাদ আছে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’ আজ আমি কারো ওপর এভাবে ইহসান করলে ভবিষ্যতে আমার বিপদে মানুষ পাশে দাঁড়াবে। ইহসান সম্পর্কে কোরআনে বহু ফজিলত এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিত্তবান হয়েও যারা মানুষের ওপর ইহসান করেনি, তাদের ইতিহাস তোলে ধরা হয়েছে। যেন মানুষ তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ইহসান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইহসান করো। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইহসানকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত নম্বর: ১৯৫)। ইহসান না করার কারণে কারূনের পরিণতি তোলে ধরা হয়েছে। আমরা জানি অনেক সম্পদশালী একজন ব্যক্তি ছিলো কারূন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পেয়ে হজরত মূসা (আ.) কারূনকে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমার ওপর যেমন ইহসান করেছেন তুমিও মানুষের ওপর সেভাবে ইহসান করো।’ (সূরা: কাসাস, আয়াত নম্বর: ৭৭)। কারূন, হজরত মূসা (আ.) এর কথা শুনেনি। পরিণতিতে আল্লাহ তায়ালা ওর সম্পদ মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেন। 

করজে হাসানা দ্বারা মানুষের পেরেশানি দূর করার ফজিলত লাভ হয়:

মানুষ আর্থিক পেরেশানিতে পড়েই ঋণ নিতে চায়। তাই কেউ কাউকে করজ দেয়ার অর্থ হচ্ছে, সে তার এই পেরেশানিকে দূর করে দিলো। মানুষের পেরেশানি দূর করার জন্য রাসূল (সা.) অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে সহিহ মুসলিমে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের ওপর থেকে কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার ওপর থেকে কষ্ট দূর করে দেবেন। অসচ্ছল ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি ঋণ দেয়াকে সহজ করে দেবেন, আল্লাহ তায়ালা তার দুনিয়া এবং আখেরাতকে সহজ করে দেবেন।... আল্লাহ তায়ালা বান্দার সহযোগী হয়ে থাকেন, বান্দা যতক্ষণ অন্য কারো সহযোগী হিসেবে থাকে।’ (হাদিস নম্বর: ২৬৯৯)।

করজে হাসানা সম্পর্কে কোরআন হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন বিধিবিধান:

কোরআন ও হাদিসে সরাসরি কোনো বিধান বর্ণিত হওয়া দ্বারা ওই বিধানের প্রয়োজনীয়তা ও সামাজিক গুরুত্বের বিষয়টি ওঠে আসে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ হে ইমানদারগণ! যখন তোমরা পরস্পরের মাঝে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের লেনদেন করো, তখন তা লিখে রাখো।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত নম্বর: ২৮২)। উক্ত আয়াতটি অনেক লম্বা। সেখানে করজে হাসানার আরো বিধিবিধান এসেছে। বলা হয়েছে, ‘আর যার ওপর ঋণ, সে লেখাবে এবং সে যেন তার রব আল্লাহকে ভয় করে এবং তা থেকে যেন কিছু না কমায়।’ এভাবে আরো বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে দু’জনকে সাক্ষী রাখো, তবে যদি দু’জন পুরুষ না থাকে তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষী হবে।’

কোরআনের ন্যায় হাদিসেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিধিবিধান বর্ণনা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘পূর্ববর্তী নবীর একজন উম্মত মারা যাওয়ার পর ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি কোনো ভালো কাজ করে এসেছো? সে বলে, না। আমি দুনিয়ায় কোনো ভালো কাজ করে আসিনি। তবে আমি একজন সম্পদশালী লোক ছিলাম। সন্তানাদিকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম, তারা অসচ্ছল ব্যক্তিকে পাওনা আদায়ের জন্য যেন সময় সুযোগ বাড়িয়ে দেয় এবং সচ্ছল মানুষের ক্ষেত্রেও কিছু ছাড় দেয়। তখন ফেরেশতারা বলেন, আল্লাহ তায়ালাও তেমনিভাবে তোমাকে আজ ছাড় দিয়েছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১৫৬০)।

এক লোক ফলের ব্যবসা করতো। কিন্তু ব্যবসায় সে লোকসানের মাঝে পড়ে। তার কাছে মানুষের পাওনা হয়ে যায় অনেক। তখন রাসূল (সা.) সবাইকে নির্দেশ দিলেন, তাকে দান সদকা করতে। সবাই দান সদকা করার পরও ঋণ পরিশোধের মতো অর্থ জমা হলো না। রাসূল (সা.) তখন পাওনাদারদেরকে বলেন, ‘তোমরা যা পেয়েছো তাই নিয়ে চলে যাও। তোমাদের জন্য এই সম্পদ ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১৫৫৬)। ফিকহের কিতাবেও করজে হাসানা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।  

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –