• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

এক মৃত্যুহীন প্রাণ

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২১  

আবদুল মান্নান

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের মধুমতী নদীর তীরের এক নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুত্ফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক পরিবারের প্রথম বালক। নাম রাখা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান। মা-বাবার কাছে শেখ মুজিব হলেন ‘খোকা’। বাড়ির বড় ছেলে বলে আদরটা একটু বেশি। সেই আদরের নামই খোকা। সেই খোকাকে নিয়ে পরিবারের কতই না স্বপ্ন। বাবা স্বপ্ন দেখতেন তাঁদের আদরের খোকা একদিন বড় হয়ে বড় আইনজীবী হবেন। ইচ্ছা করলে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারিও পড়তে  পারেন। কিন্তু খোকার তো জন্ম হয়েছে এই দেশের নির্যাতিত মানুষের সেবা করার জন্য। সেই খোকা একদিন হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলার বন্ধু, বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে হত্যা করার পর তিনি হয়ে উঠেছেন এক মৃত্যুহীন প্রাণ।

kalerkanthoবালক শেখ মুজিব যে তাঁর সমসাময়িক আর দশজনের মতো ছিলেন না তা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এসেছেন। টুঙ্গিপাড়ায় স্কুলের পাট শেষ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। টুঙ্গিপাড়ায় থাকতেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত ও অনুসারী। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও তরুণ মুজিবকে খুব পছন্দ করতেন। কারণ ছোটবেলা থেকেই মুজিব ছিলেন একজন ভালো সংগঠক। তাঁর ছিল বেশ কিছু করিতকর্মা অনুসারী। তাঁর এই গুণাবলির কারণেই তিনি কলকাতায় গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে সেই কলেজের অনেকটা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হতে পেরেছিলেন। তবে তরুণ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় মেলে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময়। তরুণ মুজিব তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বাংলার কলকাতা ছাড়াও অন্যান্য দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন। আবার দাঙ্গার সময় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামের একটা অদ্ভুত নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। মাঝখানে হাজার মাইলের ভারত বা হিন্দুস্তান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই কিছু ফেরেববাজ মুসলিম লীগ নেতা এটা বলা শুরু করলেন—পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, যা ছিল পাকিস্তানের মাত্র ৬ শতাংশ মানুষের ভাষা। আর বাংলা ছিল পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা। জিন্নাহ নিজে উর্দু জানতেন না; কিন্তু তাঁকে বোঝানো হয়েছিল উর্দু মুসলমানদের ভাষা, যা মোটেও সত্য নয়। ধর্মের কোনো ভাষা থাকে না। জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। যে কজন জিন্নাহর এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ুয়া তরুণ শেখ মুজিবও ছিলেন। শুরু হলো বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সামনের কাতারে থেকে অন্যদের সঙ্গে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিরা যখনই তাদের কোনো ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলন করেছে, সেখানে তারা ভারতীয় হিন্দুদের ষড়যন্ত্র দেখেছে।

একটি স্বাধীন দেশ পরিচালিত হয় তাঁর সংবিধান দ্বারা। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্রে দেশটির প্রথম গণপরিষদ সেই সংবিধান প্রণয়ন করেও তার বাস্তবায়ন করার আগে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সেই গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০ জন সদস্য নিয়ে আরেকটি নতুন গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে পূর্ব বাংলার ৪০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়, যার মধ্যে শেখ মুজিবও ছিলেন। তিনি তখন ছিলেন কারাগারে। শেখ মুুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান গণপরিষদে অংশগ্রহণ করেন। গণপরিষদের প্রতিটি অধিবেশনেই শেখ মুজিব যে কটি বিষয় নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন, তার মধ্যে ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা, পূর্ব বাংলাসহ পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন এবং সরকারি চাকরিতে প্রদেশগুলোর জনসংখ্যাভিত্তিক নিয়োগ। এর আগে নির্ধারিত হয়েছিল পাকিস্তানের দুটি অংশ হবে দুটি ইউনিট, যার অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস হলেও তার অবস্থান হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সমান। এর অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলা যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস, তা অস্বীকার করা। পাকিস্তানের হবে দুটি ইউনিট এবং এই দুই ইউনিট সব কিছুতেই সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। এখানে জনসংখ্যাকে গৌণ করে দেওয়া হলো। তিনি পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখারও তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি এই গণপরিষদে পূর্ব বাংলার স্বার্থ নিয়ে অনেকটা একাই লড়াই করছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায় করা যাবে না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদ দেশটির প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করে এবং ঘোষণা করে তার অধীনে ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার মানবে কেন? তা যদি হয়, তাহলে তাদের আধিপত্য তো খর্ব হবে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন, সংবিধান বাতিল করে শেখ মুজিবসহ দেশের সব রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করেন। ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায়  ২৭ অক্টোবর মির্জাকে সরিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানে গণতন্ত্র ধ্বংস করার নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়।  

আইয়ুব খান তাঁর ডায়েরিতে শেখ মুজিবকে একজন বিপজ্জনক মানুষ ও আপদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং মনে করতেন মুজিব তাঁর জনগণকে প্রতারিত করছে।

(Diaries of Field Marshal Mohammad Ayub Khan, 1966-1972. Page 88)| আইয়ুব খান ১০ বছর দেশ শাসন করেছেন, যার বেশির ভাগ সময় শেখ মুজিব কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগার থেকে বের হয়ে এক পর্যায়ে শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন ১৯৬৬ সালে। এই সময় শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছয় দফার বিভিন্ন দিক নিয়ে মানুষকে বোঝাতে সভা-সমাবেশ করে বেড়ান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে আইয়ুব খান পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করার অভিযোগ তথা কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন। ছাত্রদের গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সেই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। ২৫ মার্চ আইয়ুব খানকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ঘোষণা করেন এক ব্যক্তি এক ভোট—এই ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পরদিন আইয়ুববিরোধী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালির মহানায়ক, যেন হ্যামিলনের বংশীবাদক। মনে হচ্ছিল তিনিই বাংলাদেশ।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে পাকিস্তানে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালি আবারও শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্সে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দিলেন, যাতে তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। তিনি জনগণের অধিকার চান। শেষ করলেন এই বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই বিকেলে রমনা রেসকোর্স মাঠে রচিত হয়েছিল রাজনীতির এক কবির অমর কবিতা, যা আজ জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার পুরো সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। শুরু হলো ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে সেনা সদস্যরা আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে আবার হয়েছিল আরেকটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি দেশে ফেরেন ১০ জানুয়ারি।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরে চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। যেই স্বাধীন দেশের জন্য তিনি দুইবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, সেই দেশে তিনি বেঁচে ছিলেন এক হাজার ৩১৪ দিন বা সাড়ে তিন বছর। যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন, তাঁরা সবাই তাঁর একান্ত আস্থাভাজন ছিলেন, বলতে গেলে ঘরের মানুষ। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া তাঁর নাম নেওয়াটাও আইন করে  নিষিদ্ধ করে দেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁরই রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে পিতার আরাধ্য কাজ শেষ করা শুরু করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তাঁর কর্মে ছেদ পড়ে। ২০০৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন। বদলে দিয়েছেন তিনি বাংলাদেশকে। বিশ্বে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের এক রোল মডেল আর শেখ হাসিনা একজন স্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক।

দেশ যখন তাঁর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে দেশটির স্থপতি আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁর অবর্তমানে যখন বাংলাদেশ তাঁর জন্মের শতবর্ষ পালন করছে, ঠিক তখনই শুরু হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র।

পিতা, আপনি যেখানেই থাকুন, এই বাংলার ১৭ কোটি মানুষের জন্য আপনি আশীর্বাদ হয়ে থাকুন, যেমনটি আপনি জীবদ্দশায় ছিলেন। তখনো আপনি বাঙালির মাথার ওপর ছায়া দেওয়া বটবৃক্ষ ছিলেন, এখনো তাই আছেন। আপনার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনার আশীর্বাদে আর আপনার কন্যার নেতৃত্বে বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।

জয় বাংলা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –