• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

কেমন ছিল সাহাবায়ে কেরামের রমজান

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২২  

রমজানে সাহাবায়ে কেরামের আমল ছিল বর্ণনাতীত। তারা রমজান আসার আগে থেকেই নিজেদের আমলের বিন্যাসের জন্য সময় নির্ধারণ করতেন। কোনোভাবে সময় নষ্ট হতে দিতেন না। রমজানে বিশেষ যে ইবাদতগুলোর প্রতি তারা গুরুত্বারোপ করতেন তার কিছু বিবরণ-

দিনের বেলায়ও মসজিদ আবাদ

ইবনে আবি শায়বা আবুল মুতাওয়াক্কিল থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবু হুরাইরা (রা.) এবং তার সাথি রোজা রাখলে মসজিদে বসে থাকতেন।’ (আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস, মাদ্দাহ : যারাবা)। বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমজানে ইতেকাফ করতেন। বিশেষ করে শেষ দশকে।

কোরআনের মাসে তেলাওয়াতের আধিক্য

সাহাবায়ে কেরাম রমজানে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কিছু কিছু সাহাবায়ে কেরাম শুধু কোরআন তেলাওয়াতের জন্য (কর্ম থেকে ) অবসর নিতেন। এটাকেই নিজের ব্যস্ততা বানাতেন। মারওয়াজি (রহ.) কাসেম (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে মাসউদ (রা.) সাধারণত এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত পূর্ণ কোরআন খতম করতেন। রমজানে প্রতি তিন দিনে এক খতম দিতেন। এর মধ্যে দিনে খুব সময়ই ব্যয় করতেন।’ (আসসুনানুল কোবরা লিলবায়হাকি : ২/৩৯৪)।

আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর আমল ছিল, রমজানে দিনের শুরুভাগে কোরআন তিলাওয়াত করতেন, সূর্য উদিত হয়ে গেলে শুয়ে পড়তেন।’ (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা : ১৭১)।

অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা

আবু জর (রা.) সাথিদের নসিহত করে বলতেন, ‘যখন তোমরা রোজা রাখো, তখন যতটুকু সম্ভব অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাক।’ এ হাদিসের বর্ণনাকারী তালিক (রহ.) সম্পর্কে জানা যায়, ‘তিনি মাহে রমজানে ঘর থেকে শুধু নামাজের জন্য বের হতেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)।

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘যখন তোমরা রোজা রাখবে, তখন তোমাদের কান, তোমাদের চোখ, তোমাদের জবান মিথ্যা ও গোনাহ থেকে রোজা রাখবে। খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। রোজার দিন তোমাদের গাম্ভীর্যভাব নিয়ে থাকবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯৮৭৩)।

ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘রোজা শুধু পানাহার বর্জনের নাম নয়; বরং রোজা মিথ্যা, বাতিল ও বেহুদা কসম খাওয়া থেকে বর্জনের নামও।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯৮৭৫)। এ ধরনের কথা আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) থেকেও বর্ণিত আছে। (প্রাগুক্ত : ৯৮৭৭)।

অসহায় ও মেহমানদের দাওয়াত

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আসহাবে সুফফাদের খাবার দিতেন। কারণ, তারা মুসলমানদের মধ্যে জীবনযাপনের দিক থেকে দুর্বল ছিলেন। মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। ওয়াসেলা ইবনে আসকা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রমজান এলে আমরা সুফফায় থাকতাম, আমরা রোজা রাখতাম, যখন ইফতার করতাম, তখন আমাদের একেকজনের কাছে একজন এসে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবার খাওয়াতেন।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া : ৩/২২)।

সাহাবায়ে কেরাম প্রতিনিধি দল এবং মেহমানদের জন্য খাবার পাকাতেন। আলকামা ইবনে সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ সাকাফি স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমরা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থেকে রাসুল (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসতাম। তিনি আমাদের জন্য মুগিরা ইবনে শু’বার ঘরের পাশে দুটি তাঁবু টানিয়ে দিতেন। বেলাল (রা.) আমাদের কাছে ইফতার নিয়ে আসতেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, ‘বেলাল, রাসুল (সা.) ইফতার করেছেন? বেলাল (রা.) বলতেন, হ্যাঁ, আমি তোমাদের কাছে রাসুল (সা.) এর ইফতার করার পরই এসেছি এবং আমরাও খেয়ে এসেছি। বেলাল (রা.) আমাদের কাছে সাহরিও নিয়ে আসতেন।’ (আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৪২০০)।

আবদুল্লাহ ইবনে রাবাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এক প্রতিনিধি দল মুয়াবিয়া (রা.) এর কাছে এলেন। তখন রমজান মাস ছিল। আমাদের কেউ কেউ অল্প খাবার তৈরি করতেন। আবু হুরাইরা (রা.) খুব করে আমাদের হাওদাতে ডাকতেন। অতঃপর আমার সাক্ষাৎ আবু হুরাইরা (রা.) এর সঙ্গে হয়। আমি বললাম, আজ রাতে আমার এখানে দাওয়াত নেন। আবু হুরাইরা (রা.) বললেন, আপনি আমার ওপর অগ্রগামী হয়েছেন। আমি বললাম, জী, হ্যাঁ, অতঃপর আমি লোকদের দাওয়াত দিলাম।’ (মুসলিম : ১৭৮০)।

সাহরি ও ইফতারিতে দাওয়াত

তাউস (রহ.) থেকে বর্ণনা আছে, আমি ইবনে আব্বাস (রা.) কে বলতে শুনলাম, ‘ওমর (রা.) সাহরিতে আমাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছেন। এরই মধ্যে লোকদের হট্টগোল শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী হচ্ছে? আমি বললাম, মানুষ মসজিদ থেকে বের হচ্ছে।’ (মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল : ৯৭)। মূলত লোকেরা যৌথভাবে সাহরি খাওয়ার পর বের হচ্ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সঙ্গে কখনও তার শাগরেদ সাহরি খেতেন, কমবেশি যা কিছু থাকত। তিনি বিলম্বে সাহরি খেতেন। ইবনে আবি শায়বা আমের ইবনে মাতার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহর কাছে তার ঘরে এলাম, তিনি সাহরির অতিরিক্ত খাবার বের করলেন। আমরা তার সঙ্গে সাহরি খেলাম। নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা বের হলাম এবং তার সঙ্গে নামাজ পড়লাম।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯০২৪)।

সিলাহ ইবনে যুফার বলেন, আমি হুজাইফা (রা.) এর সঙ্গে সাহরি খেলাম। তারপর মসজিদে চলে গেলাম। দুই রাকাত ফজরের সুন্নত পড়লাম, অতঃপর নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা নামাজ পড়লাম।’ (নাসায়ি : ২১৫৪)।

সাহাবাদের রাতের আমল

সাহাবায়ে কেরাম সারাবছর নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। রাতের একভাগ আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। অবশ্য রমজানে প্রায় পুরো রাত ইবাদতে ব্যয় করতেন। নফল নামাজে দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন। এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক কিংবা রাতের বেশিরভাগ সময় তেলাওয়াতে কোরআন, নামাজ, জিকির-আজকার ও ইস্তিগফারে ব্যয় করতেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাজম (রহ.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি আবু জর গিফারি (রা.) কে বলতে শুনলাম, আমরা রমজানে রাতের নামাজ থেকে ফিরে এসে খাদেমদের তাড়াতাড়ি খাবার আনার জন্য বলতাম, যেন সুবহে সাদেক না হয়ে যায়।’ (মোয়াত্তা ইমাম মালেক : ১/১১৪)।

শেষ দশকের আমল

রমজানের শেষ দশকের ইবাদতে সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ-উদ্দীপনা অনেক বেড়ে যেত। নিজেও ইবাদতে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) শেষ দশকে পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। যেমনটা রাসুল (সা.) করতেন। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.) শেষ দশকে পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন।’

সাহরিতে সাহাবায়ে কেরামের আমল ছিল বিলম্বে সাহরি খাওয়া। বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সাহরি শেষ করা এবং ফজরের আজানে ৫০ থেকে ৬০ আয়াতের ব্যবধান থাকত। খাওয়ার কিছু না থাকলে এক ঢোক পানি পান করে নিতেন। কেননা সাহরি এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য। ইফতারে সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য ছিল, মাগরিবের আজান হতেই খেজুর খেয়ে নিতেন, খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে ইফতার করতেন। অথবা যা কিছু নাগালে থাকত এ দিয়ে ইফতার করতেন। ইফতারের সময় সুন্নতসম্মত দোয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন।

বদান্যতা ও দানশীলতা

এ বরকতময় মাসে সাহাবায়ে কেরামের দানশীলতা তুঙ্গে থাকত। সাধারণত নিজের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দিতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থাকতেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সাহাবায়ে কেরামের এ গুণের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে ঈদের দিনে সদকায়ে ফিতর ছাড়াও গরিব-অসহায় মানুষদের মাঝে এত দান করতেন, যাতে কেউ এ দিনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়।

মাহে রমজান অতিবাহিতকারী তিন দলে বিভক্ত। একজন এমন যার এ মাস এবং বছরের অন্যান্য মাসে কোনো তফাৎ হয় না। সে হলো অকৃতকার্য হতভাগা। দ্বিতীয়জন হলেন আবেদ শ্রেণির। শুধু ইবাদত করেন। তার রমজানের সওয়াব তো হয়; কিন্তু রমজান মাস চলে যেতেই তার ইবাদতের আগ্রহ-উদ্দীপনা সব শেষ হয়ে যায়। তিনি আবার আগের জীবনে ফিরে আসেন। তৃতীয়জন হলেন, যিনি একাগ্রচিত্তে ইবাদতে মনোযোগী হন। তিনি এ মাসকে গনিমত মনে করে এর মধ্যে বেশির চেয়ে বেশি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন। ফলে তার আগের ও পরের জীবনে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় প্রকারের এ ব্যক্তিই আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের মতো রমজান মাসে বেশি বেশি ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –