• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ধনীর নয়, সাম্যের রাষ্ট্র চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০২২  

ধনীর নয়, সাম্যের রাষ্ট্র চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু                                
ড. মীজানুর রহমান
একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তিনি কীভাবে করেছেন তা তার রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যায়। 

হিস্টোরিওগ্রাফির জনক ইবনে খলদুন ১৩৭৭ সালে তার বিখ্যাত বই মোকাদ্দিমায় লিখেছেন, যে প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে, সেই প্রেক্ষাপট না জেনে কোনো কিছু উপস্থাপন করলে আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্র আমরা কীভাবে পেলাম, কী অবস্থায় এটা তৈরি হলো- এর প্রেক্ষাপট জানা দরকার। 
প্রথমে আমি অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত ১৬৩৭ সালে Discourse on the Method বইতে বলেছেন, কোনোকিছু শুরু করার সময় অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কেও আমি অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। আমরা মনে করি, আমরা কখনই অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না। 

আমি এর উদাহরণ দেব শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে। তিনি লিখেছেন-
“আমার এক বন্ধু ননীকুমার দাস, একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে’।” 

১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের সময়ের কথা। আজকের বাংলার ইসলামি জাগরণের কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম তখন প্রখ্যাত, যার গজল ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয় বিগলিত করেছে। তিনি আবার অনেক শ্যামাসংগীত, ভজনও লিখেছেন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের জন্য নজরুল ফরিদপুর গিয়েছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের মানুষ ‘ইসলামি জাগরণে’র এই কবিকে একদিন-একরাত পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। তাদের অভিযোগ ‘এটা’ হিন্দু হয়ে গেছে। যেহেতু শ্যামা সংগীত-ভজন লিখেছে, অতএব তিনি আর মুসলমান নেই।
ব্রিটিশরা যখন ঔপনিবেশিক শাসন ছেড়ে চলে যাচ্ছে বা যেতে বাধ্য হচ্ছে, তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের দুটো জাতিতে বিভক্ত করে। একটা হিন্দু, আরেকটা মুসলমান। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা তাদের চক্রান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান এবং ভারত দুটো রাষ্ট্র তৈরি করে। হিন্দুদের একটা রাষ্ট্র। মুসলমানদের আরেকটা রাষ্ট্র। যদিও এর মধ্যে কারসাজি ছিল।
পূর্ববঙ্গের মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য ভোট দিয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে কখনই এরকম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভাবনা স্থান পায়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঙালি জাতীয় চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশই তার কল্পনার রাষ্ট্র ছিল। তবে সে সময়ের বাস্তবতায় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে হঠাৎ করে একটা রেডিক্যাল কিছু করা বাস্তবসম্মত নয় বলেও মনে করতেন তিনি। 
আজকের যে ‘আওয়ামী লীগ’ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল, সেটা কিন্তু প্রথমে ‘আওয়ামী লীগ’ ছিল না। ছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু অনেকটা একক কর্তৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেন। শুরুতেই এটা করা হলে দলটি এভাবে এ পর্যায়ে আসতেই পারত না। কারণ মানুষের মন-মানসিকতা তখনও ওইভাবে তৈরি হয়নি।
আরেকটা প্রচলিত বিশ্বাস: আমরা প্রায়ই বলি স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতি ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এটাও আমি বিশ্বাস করি না। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে একটা মিটিং হয়েছিল, এই যে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রটা হলো এটার রাষ্ট্রভাষা কী হবে? সেখানে যত বাংলা ভাষাভাষী গণপরিষদ সদস্য (এমসিএ) ছিল, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া সবাই বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। 

পাকিস্তান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যে, এদেশে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া যাবে না। মাত্র ১০ জন বুদ্ধিজীবী এটার প্রতিবাদ করেছিলেন। পরদিন পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ১১০ বুদ্ধিজীবী। 
ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম দফাটি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে। ভারত ছয় দফা প্রণয়ন করে দিয়েছে – এমন প্রচার চালানোর বহু লোক এদেশে ছিল। জামায়াতে ইসলামী শেখ মুজিবকে ভারতের এজেন্ট আখ্যা দিয়ে ছয় দফা ভারত প্রণীত বলে দাবি করে। বাঙালিকে হতবাক করে দিয়ে মাওলানা ভাসানীও ছয় দফাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। 

১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আওয়ামী লীগ পেয়ে যায়। তবে তারা ভোট পেয়েছিল ৭২. ৫৭ শতাংশ। এর আরেক অর্থ হলো ২৭.৪৩ শতাংশ বাঙালি স্বাধীনতা তো দূরের কথা, ছয় দফারও বিরুদ্ধে ছিল। অতএব আমরা সমগ্র জাতি মিলে যুদ্ধ করেছি এটা সঠিক বলি না। এই ২৭.৪৩ শতাংশ লোক আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং হত্যা, রাহাজানি, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণ করেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে। 

১৬ ডিসেম্বর আমাদের দেশ বিজয় লাভ করার মাত্র নয় দিন আগের ঘটনা। ৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটিতে ১১০ দেশ আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। সৌদি আরব আমাদের স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায়। প্রথমে তারা নিশ্চিত হয় যে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পন্ন হয়েছে, এর পরেই আমাদের স্বীকৃতি দেয়। 
বিদেশি শত্রু যারা ছিল তাদের আবার শাখা-প্রশাখা ছিল দেশের ভেতরে, যাদেরকে আমরা বলি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী। এদের বিভিন্ন সংঘবদ্ধ দল ছিল, যেমন, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি। প্রত্যেকটা দল অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল এবং কোথাও কোথাও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য এই সংঘবদ্ধ দলগুলো সক্রিয় ছিল।

’৭১-এ আমরা যে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করলাম, ১৯৭৫ সালে এটাকে আবার কার্যত পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যত অনুষঙ্গ ছিল, সব ফিরে এল। একজনের পর একজন জেনারেল এলেন, আমাদের গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দী করা হলো। 

আমরা ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ ছিলাম ২০-২১ বছর। আমাদের প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, তথাকথিত ‘হাঁ/না’ ভোটের মাধ্যমে বৈধতা আদায় করেছিলেন। তথাকথিত ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে থেকেই নির্বাচিত হতেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন। প্রেসিডেন্ট বদল হলো, ‘শর্ষিনা-সানগ্লাস-সাফারি’ থেকে ‘আটরশি-হেলিকপ্টার-মেরীর’ দিকে চলে গেল। জেনারেল শুধু বদল হলো। একই বলয়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সার্বভৌমত্ব আটকা পড়ল।

১৯৯৬ সালে ‘পাকিস্তান’ থেকে আবার বাংলাদেশ হলো। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির জনক স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেটার পুনর্জন্ম হয়। আমরা এখন একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটা বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের কথা। 

বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বিবেচনা করলে গণতন্ত্রের ভেতরে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা যাবে। গণতন্ত্র বলতেই বুঝানো হয় ‘সবাই যেটা বলবে অথবা মেজোরিটি লোক যেটা বলবে এটাই মেনে নেওয়া’। তবে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, একজনও যদি ন্যায্য কথা বলেন, সেটা মেনে নেয়াই হচ্ছে গণতন্ত্র।  
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল গৃহীত হওয়ার পরদিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন- 
“আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের নয়। ...  যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা ভোট কেনার জন্য পয়সা পায়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র।’ 

আমাদের জাতীয় পরিচয় কী হবে, এটা নিয়েও বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। আমরা বাঙালি ছিলাম, আমাদের বাংলাদেশি করে দেওয়া হলো। ১৯৭২ সালে জাতির জনক আমাদের যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেটার একটা বড় স্তম্ভ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে ভাষণে বলেছিলেন: 
‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।’

এই তিনটা পরিচয় অর্থাৎ বাঙালি, মানুষ, মুসলমান – এর সংমিশ্রণটা আমরা পেয়েছি। একটা কথা বলতে চাই, আমরা যে মুসলমান এটার সঙ্গে মরুভূমির মুসলমানের পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে যারা ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন সুফি-সাধক। শাহজালাল, বায়েজিদ বোস্তামি, খান জাহান আলী প্রমুখ ওলি-আউলিয়া। তারা আমাদের বলেছিলেন আল্লাহ এক, নামাজ পড়, চুরি কোরো না, মিথ্যা বোলোনা – এর চেয়ে বেশি তারা বলেননি। তারা বলেছেন, তোমরা যেভাবে আছো সেভাবে থাকো। বাঙালির মধ্যে যা আছে, তা নিয়েই থাকো। 

ইসলাম এত দ্রুত একসেপটেড হলো কীভাবে? এই এলাকার ধর্ম প্রচারকরা বাঙালি সংস্কৃতি যেটা ছিল এর সাথে মিশ্রণ করার জন্য ইসলামের কতগুলো আদি ও অকৃত্রিম কথা বললেন। সেগুলোর সাথে বাঙালিত্বের অনুষঙ্গগুলো অব্যাহত রাখতে বললেন। এগুলোকে পাল্টাপাল্টি করে দাঁড় করাননি। তারা বলেছিলেন, তুমি যেভাবে বাঙালি আছো সেভাবেই থাকো। যার কারণে দ্রুত এখানে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। এখন যেভাবে ‘হুজুর’রা ইসলামের কথা বলেন, যদি সেভাবে ইসলাম আসতো, তাহলে আর ইসলাম কায়েম হতো না।

বাঙালির সংস্কৃতি ও মানবিকতা মিশিয়ে জাতির জনকও বলেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তার অন্যতম ভিত্তি হলো অসাম্প্রদায়িক চিন্তা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও অন্যতম দার্শনিক ভিত্তি এটা। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ একই সূত্রে গাঁথা। এর বিপরীতে রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ (নাগরিকত্ব অর্থে নয়, চেতনাগত অর্থে)।

এটা সত্য, বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। জনসাধারণের দুঃখ লাঘব করতে তখন তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে কাজ করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তিনি সুষম খাদ্য বণ্টনের আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ মুজিব ছুটে বেড়ান দাঙ্গাকবলিত মুসলমান-হিন্দু দুই জনগোষ্ঠীকেই উদ্ধার করতে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর লিখেছেন- 
‘দু-এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সুসংহত করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়েই। আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতাকেও আমরা সেই মতাদর্শের পক্ষে কলম ধরতে দেখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলায় হিন্দু-মুসলমান বিভেদে রাজি ছিলেন না। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালির সমর্থন পেতে কখনও হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। 

ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র সফল নেতা যিনি হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু এমনকি বাঙালিদের অন্য কোনো জাতির বিরুদ্ধে, যেমন বিহারিদের বিরুদ্ধে, সহিংস আচরণে প্ররোচনা দেননি। বরং তাদের নিরাপত্তা দিতে ৭ মার্চের ভাষণে নির্দেশ দিয়েছেন: 
‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সাম্যের কথাটা এসেছিল সমাজতন্ত্র হিসেবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি দর্শনগতভাবেই মানুষে মানুষে বিভেদ উদ্রেককারী। আর এইজন্য অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলছেন-
‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’   

তখন সমাজতন্ত্র একটা রোমান্টিক শব্দ। কেবল মনোজগতে নয়, ব্যক্তি জীবনেও বঙ্গবন্ধু সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখি, দাওয়ালদের (যারা ধান মৌসুমে দিনমজুর হিসেবে ধান কাটে) যৌক্তিক দাবি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সরকার যখন তাদের ধান কেড়ে নেয়, তখন তরুণ মুজিব প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন বৈষম্যহীনতা চর্চার কথা। কারাগারে তিনি সবার সঙ্গে এক কাতারে খেতেন, যেমন ব্যবস্থা ছিল তাঁর নিজ বাড়িতে:
“আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম।...আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদ ছিল, তখন জমিদার, তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।”

যেটা বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি আমরা। আজকে আমরা শুনি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে ২০৩০ সালে। মোটামুটি ২০৪০ সালে আমরা ধনী বাংলাদেশ হয়ে যাব। আর আমাদের সব রাস্তা দোতলা হবে, ফ্লাইওভার থাকবে সর্বত্র, দোতালা তিন তলা বিল্ডিংগুলো আরো উঁচু হয়ে যাবে। আমার মনে হয় না জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এরকম ছিল। জাতির জনকের যে স্বপ্নের সোনার বাংলা সেটা ছিল সাম্যের বাংলাদেশ। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি প্রধানত শোষণমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতেন। ১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণের পর তিনি লেখেন-
‘তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ ও এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।’ 

বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শোষণমুক্তি এবং বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। চীনে গিয়ে তার এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন – ‘আজ চীন দেশ কৃষক-মজুরের দেশ। শোষক শ্রেণি শেষ হয়ে গেছে।’ 
অনেক স্বপ্নই আমরা এখন দেখি, বঙ্গবন্ধু এত স্বপ্ন দেখেননি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল মিলেমিশে বাংলাদেশ ধনী-গরিব, পুরুষ-মহিলা, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই মিলে সাম্যের বাংলাদেশ। সবাই মিলেমিশে থাকব। এখান থেকে কোনোভাবে আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না এবং সেটাই আমাদের অর্জন করতে হবে। 

দেশের ও আশেপাশের মৌলবাদী আগ্রাসন রোধে এবং নিকৃষ্টতম চলমান লুণ্ঠন ও দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়তে আমাদের তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার কাছে ফিরতে হবে; বাংলাদেশকে তার দার্শনিক ভিত্তি- বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজকে রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –