• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

কমিউনিটি ক্লিনিক: সুশাসন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২  

কমিউনিটি ক্লিনিক: সুশাসন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি                        
আধুনিক বিশ্বে সুশাসন (good governance) বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দৃশ্যমান সেতুবন্ধন। একটু পরিস্কার করে বললে, ক্ষমতার সুষ্ঠু চর্চায় সুশীল সমাজ তথা সাধারণ মানুষের স্বাধীন অংশগ্রহণ। তবে এগুলো জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে, কল্যাণ রাষ্ট্র  (welfare state) বলতে যেখানে জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা বিদ্যমান। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত সুবিধাবঞ্চিত বার্ধক্যপীড়িত বা দুস্থ নাগরিকের জীবনে সামান্য হাসি ফোটানোর সক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র। 

২) বাংলাদেশে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সূচকের প্রেক্ষাপটে নাগরিকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর দায় রাষ্ট্রকে বহন করতে হয়। সংবিধানের ভাষ্য মতে "রাস্ট্র নিশ্চিত করিবেন "। আমাদের সংবিধানেও এর ব্যতিক্রম
নেই। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গণপরিষদে গৃহীত ও পাশকৃত মূল সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১৫ (ক)তে বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে অন্ন বস্ত্র আশ্রয় শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা"। ১৮ (১) এ আরও স্পষ্ট করা হয়েছে, "জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গন্য করিবেন"।  
সে সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "যতদিন না এদেশের সকল মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা নিশ্চিত হবে ততদিন আমার মুখে হাসি ফুটবে না"। 

৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগুলো ছিল মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক। অথচ সে সময় ৮৫% মানুষ গ্রামে
বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রতিটি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল চালু করেছিলেন। যা পরবর্তীতে যথাক্রমে ৩১, ৫০ ও ১০০ শয্যা হয়েছে। 
১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে প্রথম রক্তসংরক্ষণাগার ও মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বলেছিলেন," ডাক্তারগন যখন তখন ছুটিতে যাবেন না। আপনাদের সকল সুবিধা, বড় বড় অফিস, বড় বড় ডিগ্রি সবই আমার গরীব মানুষের পয়সায় হয়েছে। তাদের দেখলে তাড়াইয়া দিবেন না, দরজা বন্ধ করবেন না। তাদেরকে কাছে টানুন, সবার মনোভাব পরিবর্তন করুন "।

৪) আজকের বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার এমন অভূতপূর্ব ধারণার রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এটি তাঁর একক অবদান। বলা যায়, স্ব মস্তিষ্কপ্রসূত (own brain child) যা এখন অনস্বীকার্য এবং দিবালোকের মতো সত্য। এর মাধ্যমে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অধীনে আনাই প্রধান টার্গেট। জাতির পিতার মহাপ্রয়ানের ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ যখন দলীয় সরকার গঠন করে তখনই তাঁর কন্যা পিতার আদর্শিক চেতনাকে অদৃশ্য প্রণোদনা ও শক্তির আধার হিসেবে গ্রহণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই দার্শনিক আইডিয়াকে সম্বল করেই তৎকালীন স্বাস্থ্য কর্মীগন মাঠে নামেন। যা গ্রামীণ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বিশেষ করে নারীদের কাছে দেখা দেয়, উষর মরুভূমিতে আঁচলভর্তি শীতল জলের ফল্গুধারার মতন। যদিও পরবর্তীতে সরকারের আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এমন জনবান্ধব ও গণহিতৈষী কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় প্রান্তিক মানুষের জন্য এমন অভিনব সৃষ্টি তথা কল্যাণকর এ অভিযাত্রা। হঠাৎ যেন হতাশার কালো মেঘে ছেয়ে যায় গ্রামবাংলার স্বচ্ছ নীলাকাশ। হাজার প্রশ্নের একটাও জবাব মিলেনি। তখন সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ ছিলনা কেন ক্লিনিকগুলোর দরজায় তালা পড়ে।  

৫) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠিত হলে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৮ সালে 'কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট' নামে একটি আইন করা হয়। যা ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর সংসদে পাশ হয়। এটা ছিল ৫২ নং আইন। অল্প সময়ের ব্যবধানে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন হয়। ২০১৮ সালেই ১৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড হয়। এতে একটি উপদেষ্টা পরিষদেরও বিধান রাখা হয়। যার সভাপতি স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে দেশে ১৪,১২০টি ক্লিনিক চালু আছে। এ মুহূর্তে আরও ২০০টি নির্মাণাধীন রয়েছে। 

আগামী জুন ২০২৩ সালের মধ্যে ১৪,৮৯০টি চালু করার (অপারেশন প্ল্যানে) পরিকল্পনা আছে। প্রতি ৬০০০ মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হচ্ছে। এ বিপুল সংখ্যক কমিউনিটি ক্লিনিকের বিপরীতে সরকার ইডিসিএল (EDCL) থেকে প্রতি বছর ২৫০ কোটি টাকার ঔষধ সরবরাহ করছে। ক্লিনিক প্রতি বছরে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার ঔষধ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ৩১ প্রকার ঔষধ বিতরণ করা হচ্ছে। উল্লেখ করা যায়, বিগত জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ক্লিনিকসমূহে মোট ভিজিট হয়েছে ১০৬,৩৫৩,৭২৯। গড়ে ৩৮ জনের বেশি ভিজিট করেছে। যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। এ যাবৎ ৪০০ কমিউনিটি ক্লিনিকে ১০০০০০ (এক লক্ষের) কাছাকাছি মায়ের নিরাপদ ডেলিভারি সম্পন্ন হয়েছে। এতে কর্মরত সিএইচসিপি দের ৫৪% নারী আর ৪৬% পুরুষ। ভবিষ্যতে এ দায়িত্বে নারীদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কেননা বেশির ভাগ সমস্যা মাতৃত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এখন ৮ শতক জমিতে নতুন অবয়বে সৃষ্টি করা হচ্ছে। যা দেখতে চার কক্ষবিশিষ্ট মিনি হাসপাতালের নমুনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিজেই এর নকশা অনুমোদন করে দেন। ক্লিনিক ভবনের সর্বশেষ স্থাপত্যশৈলী খুবই নান্দনিক এবং আকর্ষণীয়। পূর্বের তুলনায় সাধারণ মানুষকে অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট করছে। 

৬) দৃষ্টান্ত হিসেবে - গ্রামীণ জনপদে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় করা যায়। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার স্ত্রী অকাল প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির স্মারক হিসেবে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের নিমিত্ত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি থেকে ১০ শতক জমি সরকারের কাছে রেজিস্ট্রি মূলে হস্তান্তর করি। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে ৮ শতক জমি প্রদান করলেই চলে। প্রাথমিক পর্যায়ে নানাবিধ বাধা ও সামাজিক জটিলতা অতিক্রম করে অবশেষে ক্লিনিকটি আলোর মুখ দেখে। খানিকটা বিলম্বের পরেও এটি কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছে যায়। গ্রামের পথ হিসেবে যোগাযোগের চমৎকার এক মোহনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শুরু থেকেই ক্লিনিকে স্থানীয় উপকার ভোগীদের উপচে পড়া আগমন ঘটে। তাছাড়া আধুনিক নকশায় চার কক্ষবিশিষ্ট সেন্টার বিধায় এটা সহজেই মানুষের নজর কাড়ে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এ কাজে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে। আজ এখান থেকেই মা ও শিশুদের জন্য বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ঔষধ পথ্যসহ করোনার টিকাও সরবরাহ করা হচ্ছে। নিয়মিত সিএইচসিপি'র উপস্থিতি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে যেন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, আলোচ্য কামরুন্নাহার জেবু কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিগত ১২-০৭-২০২১ খ্রিঃ থেকে ০৮-০৯-২০২২ পর্যন্ত (মোট ১৩ মাসে) ২০,৪৪৬ জন নারী,পুরুষ ও শিশু বিনামূল্যে ঔষধ উত্তোলন করেছে। এতে ৭,১৬৩ জন পুরুষ, ১১,৫২৪ জন নারী, ১,১৫৩ জন শিশু এবং ৬০৬ জন গর্ভবতী নারী। তথ্য মতে, দিন দিন ভিজিটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যা ইতোমধ্যে একটি মডেল কমিউনিটি ক্লিনিকে পরিণত হয়েছে। 

৭) উল্লেখ্য যে, কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ বিদ্যমান গ্রামীণ অবকাঠামোয় অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে আছে। এতে প্রান্তিক জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন থাকলেও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিগন এখনো স্বয়ংক্রিয় ভাবে এর সঙ্গে জড়িত নন। আইনের আওতায় এনে এদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র তৈরি করা প্রয়োজন। পদ-পদবি সৃষ্টিসহ জনবলের সংকট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, দুর্গম এলাকা বিবেচনা, জমির অপ্রতুলতা, এনজিওদের সমর্থন ইত্যাদি বিষয়েও নজর দিতে হবে। তবেই এর স্থায়ীত্বতা (sustainability) নিশ্চিত হতে পারে। স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর ছাড়া এসবের ভবিষ্যৎ গন্তব্য এখনো অজানা বলেই মনে হয়। 

তবে এ কথা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলা যায় যে, দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের অভূতপূর্ব সেবাদান পদ্ধতিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গরীব অসহায় ছিন্নমূল নারীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। এর পরই শিশুদের অবস্থান। তারা এখন বিনা খরচে, বিনা বাধায় হাতের নাগালেই বাঁচার এক টুকরো অবলম্বন পেয়েছেন। যার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হারে। এই যুগান্তকারী ও মানবতাবাদী পরিষেবা খাতকে সবার ওপরে স্থান দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। 


লেখক: হোসেন আবদুল মান্নান
সাবেক সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
২৫ ভাদ্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। 
#বিডি-প্রতিদিন।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –