• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

সত্যের সাধক এম এ ওয়াজেদ মিয়া

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ মে ২০২২  

ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক   

পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাকনাম সুধা মিয়া। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। ১৯৫৮ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে ডিস্টিংশনসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে।

১৯৬০ সালে এই কলেজ থেকে তিনি মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে। ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে এমএসসি পরীক্ষায় অর্জন করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান। ১৯৬১-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিতে সম্মানিত হন। তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার ফিজিকস; গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সেকালের বিখ্যাত পদার্থবিদ অধ্যাপক ই জে স্কয়ারস।

১৯৬৭ সালে ওয়াজেদ মিয়ার জীবনে নবতর অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। এ সময়টি আমাদের জাতীয় জীবনেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান সরকারের আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে।

ওয়াজেদ মিয়া মেধাবী ছাত্র হয়েও রাজনীতিসংলগ্ন ছিলেন। তৎকালীন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীই শুধু ছিলেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের নির্বাচিত সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

ওয়াজেদ মিয়ার কর্মজীবন শুরু হয় পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনের ঢাকা কেন্দ্রে যোগদানের মাধ্যমে (১ এপ্রিল ১৯৬১)। কমিশনে নিয়োজিত থাকাকালেই তিনি ইতালিতে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুস সালামের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিকস থেকে ফেলোশিপ লাভ করেন। ইতালিবাস তাঁর বিজ্ঞানীজীবনের এক অনন্য অর্জন। এর ফলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত অনেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে গবেষণার ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পান, যা তাঁর বৈজ্ঞানিক চেতনাকে অধিকতর শাণিত ও সমৃদ্ধ করেছে।

গবেষণাবৃত্তি শেষ করে ১৯৬৯ সালে ওয়াজেদ মিয়া দেশে ফিরে তাঁর কর্মস্থল পরমাণু কমিশনে যোগ দেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আরো বৃহত্তর পরিসরে গবেষণার সুযোগ হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি গবেষণা করেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের নতুন দিল্লির গবেষণাগারে। এরই মধ্যে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। পরাজিত শক্তির এ দেশীয় দোসরদের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এ হৃদয়বিদারক ঘটনায় দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্ববাসীও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অভিঘাত অবশ্যই ওয়াজেদ মিয়াকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তিনি কর্তব্য ভোলেননি, দেশে ফিরে আসেন ও কর্মস্থলে যোগদান করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর কর্মজীবন সমাপ্ত করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জামাতা কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী হিসেবে তিনি জীবনে কোনো অতিরিক্ত সুযোগ গ্রহণ করেননি।

তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার ইউটোপিকজগতে পরিভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাস্তবতাসচেতন। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্তঃসম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর কৌতূহল ও অনুরাগ।

তিনি কখনো রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে চাননি।

রাজনৈতিক ক্ষমতার বৃত্তে তিনি অবস্থান করেছেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতার উত্তাপ কখনো তাঁকে স্পর্শ করেনি।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল ভিন্ন আবেগ, যা একান্তই তাঁর। ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডি তাঁকে আবিষ্ট ও বেদনাক্ষত করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজের কর্তব্য তিনি সঠিকভাবেই পালন করেছেন। সেই চরম দুঃসময়ে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মূর্তিমান সান্ত্বনা ও পরম আশ্রয়।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া সহজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় পারিবারিক বিশেষ সহযোগিতা। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন উদার ও নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যে আস্থাশীল।

ড. ওয়াজেদ মিয়া আমাদের ইতিহাসের অংশ। তাঁর দেশহিতৈষী মানবপ্রেমই তাঁকে স্মরণে রাখবে। তাঁর মতো নির্লোভ, নিভৃতচারী, নিরহংকারী, উদার ও বিজ্ঞানবোধ পরিস্নাত মানুষ দেশ, জাতি ও বিশ্বের কল্যাণ আনে। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –