• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আছে গণকবর ও বধ্যভূমি

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২২  

ড. সুলতান মাহমুদ রানা   

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর শুধু ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই শুরু হয়েছিল দুর্বার অসহযোগ আন্দোলন। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চুপিসারে করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। এই নির্দেশের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

এটি বাঙালিদের জন্য ছিল একটি ‘কালরাত’। কারণ সেনারা মধ্যরাতের পর থেকেই নির্বিচারে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করেছিল। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার টিক্কা খান। তাঁরই নির্দেশে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওই রাতে শুধু সাধারণ মানুষের ওপর নয়, প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় বাঙালি নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরও। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের খতম করা ছিল পশ্চিমাদের একটি বড় লক্ষ্য। ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান বাহিনী যথাক্রমে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ইবিআর) সেনাদের গণহারে হত্যা করতে শুরু করে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হত্যা করে জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন জায়গায় গণকবর দেওয়া হয়। ওই  রাতে অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল।

পর্যায়ক্রমে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। কম সময়ে এত বেশি মানুষ আর কোথাও হত্যা করা হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই গণহত্যা শুরু করে। এটি ছিল মানব ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ও ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড। রাজাকার, শান্তিবাহিনী সংগঠিত হওয়ার পর গণহত্যার কার্যক্রম আরো ব্যাপক ও পরিকল্পিতভাবে চলতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ  থেকে গণহত্যা শুরু হয় এবং তা চলে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যা চালানো হয়েছিল। অনেক জায়গায় একসঙ্গে মৃতদেহ গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়েছে, যেগুলোকে আমরা গণকবর বলি। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু স্থানে নিয়েও মানুষ হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। এগুলো বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। যেমন—ঢাকার রায়েরবাজার বা শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সংরক্ষণের অভাবে অবশ্য অনেক গণকবর বা বধ্যভূমি আজ বিলুপ্ত। এক জরিপে এক হাজারের বেশি গণকবর ও বধ্যভূমির নাম পাওয়া গেছে।

গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে রবার্ট পাইন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, মূলত ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের খতম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, ‘ওদের তিন মিলিয়ন খতম করে দাও। দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। ’ সত্যি সত্যিই তিন মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে বর্বররা নির্মমভাবে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন এ দেশের চার লাখ নারী। তাদের হত্যা তালিকায় ছিল এ দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আর নারীরা শিকার হয়েছিলেন ধর্ষণ, গণধর্ষণ শেষে হত্যার, যার সূচনা হয় ২৫শে মার্চ রাতে।

১৯৭১ সালের ৭ জুন দ্য আইরিশ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাদল প্রায় দুই হাজার পুরুষকে স্ত্রী-পুত্রের কাছ থেকে সরিয়ে এনে মেশিনগান চালিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এই গুলিবৃষ্টিতে প্রায় ৮০০ জন মারা যায়। বাকিরা মৃতের ভান করে পড়ে থাকে এই আশায় যে সেনারা তাদের ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সেনাবাহিনী বাচ্চাদের খেলাঘরের মতো মৃত ও জীবিত সবাইকে একত্র করে ওদের ওপর পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা মেলে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদনে। সেখানে লেখা হয়, ‘নওগাঁর তাজ সিনেমা হলের নিকটবর্তী পুরনো পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছু দূর গেলেই দেখা যাবে ছোট একটি মসজিদ। তার পাশেই রয়েছে একটি দালানবাড়ি। বসবাস করতেন এক বিহারি ব্যবসায়ী, নাম ইদ্রিস। তাঁর বাসার ভেতর যেতেই যে কেউ চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন দুই ঘরের ভেতরে নির্মম হত্যার প্রামাণ্য চিহ্ন। একটি ঘরে অনেক দড়ি ঝুলে আছে। আর অন্যটিতে রয়েছে অসংখ্য বাঙালির রক্তের ছাপ, বিহারি ব্যবসায়ীরা খানসেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙালিকে ধরে এনে জবাই করত। খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের হত্যাকাণ্ড ছিল যেমন লোমহর্ষক, তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর। মিলের জ্বলন্ত বয়লারের ভেতরে ফেলে কমপক্ষে ৫৬ জনকে হানাদাররা পুড়িয়ে হত্যা করে। বাঙালি শ্রমিকদের এনে বসানো হতো বয়লারের সামনে বিশ ফুট উঁচু পাকা প্রাচীরের পাশে। এরপর তাদের বস্তাবন্দি করে পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। ঢোকানো অংশ পুড়ে গেলে দেহের বাকি অংশ ও মাথা একটু একটু করে বয়লারে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। গাইবান্ধার বোনারপাড়া জংশন রেলস্টেশন এলাকায় অবাঙালিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা মানুষকে কয়লাচালিত ইঞ্জিনের আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। অনেক লোককে জবাই করে হত্যা করে রেললাইনের ধারে পুঁতে রাখা হতো। এমন ঘটনা ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। হত্যাযজ্ঞগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, হত্যার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তাই সবার সন্ধান মেলানো বেশ কষ্ট।

তবে হত্যাযজ্ঞের শিকার যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা, তা সহজেই অনুমেয়। সমাজবিজ্ঞানী আর জে রুমেল তাঁর ‘ডেথ বাই গভর্নমেন্ট’ বইতে ইহুদিদের ওপর নাৎসিদের বীভৎস অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখেছেন, “প্রদেশজুড়ে যেভাবে গণহত্যা চলেছিল, তাতে হিন্দুদের দেখামাত্র গুলি চালিয়ে হত্যা করা হতো। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম পার্থক্য নির্ণয় করতে সেনারা কাপড় খুলে তাদের লিঙ্গ পরীক্ষা করত। যদি ‘মুসলমানি’ করানো থাকত, তাহলে হয়তো বাঁচা গেলেও বাঁচা যেত। তা না হলেই অনিবার্য মৃত্যু। ”

১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি রিপোর্ট বের করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের ইতিহাসে যেসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিকসংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যায়। মানবজাতির ইতিহাসে গণহত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলোতে দৈনিক গড় নিহতের সংখ্যায় এটি সর্বোচ্চ। এসব তথ্য-উপাত্ত সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ও নৃশংসতম গণহত্যা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –