• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শেখ হাসিনার স্বপ্ন এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৩ জুলাই ২০২১  

সাজ্জাদুল হাসান

বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ মূলত আধুনিক বাংলাদেশের দৃষ্টি ও দর্শন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার একটা সচেতন প্রয়াসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর দর্শন বাস্তবায়ন করে চলেছেন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দার্শনিক প্রত্যয়টির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর ২০০৮, যখন বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা গড়ার’ দৃঢ় অঙ্গীকারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান’ বা ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করে। সেই নির্বাচনী অঙ্গীকারে বলা হয়, ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি—সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ইশতেহারে ঘোষণা করে তখন অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উপহাস করেছে; বলেছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ একটি আষাঢ়ে গল্প। তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বেশ কিছু সংস্থা এবং গণমাধ্যমও এই রূপকল্পের সমালোচনা করে বলেছিল, ‘আওয়ামী লীগ দিবাস্বপ্ন দেখছে এবং দেখাচ্ছে।’ কিন্তু তাদের সবার যুক্তি ও ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বিশ্ব মানচিত্রে তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ আজ অনন্য বিপ্লব রচনা করেছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সময় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য হয়। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র  উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোপিত বীজ থেকে যে চারাগাছটির জন্ম, তারই বিকাশ দেখি ১৯৯৬ সালে। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতির পিতার স্বপ্নকেই বাস্তবায়ন করেন। ১৯৯৮-৯৯ সালের বাজেটে তিনি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন। ১৯৯৭ সালে মোবাইলের মনোপলি মার্কেট ভেঙে দেন। অনলাইন ইন্টারনেটকে সচল করেন ও দেশে বছরে ১০ হাজার প্রগ্রামার তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৫৭তম দেশ, যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। ২০১৮ সালের ১২ মে উপগ্রহটি মহাকাশে উৎক্ষপণ করা হয়। বাঙালির স্বপ্ন সেদিন আকাশ ছুঁয়েছে; লাল-সবুজের প্রতীক ‘জয় বাংলা’ খচিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এখন আমাদের গর্ব। ‘মহাশূন্যে সদা জাগ্রত, সদা তৎপর’—এই স্লোগান ধারণ করে ডিজিটাল জানালা খুলে দিয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’।

আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। আমাদের জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র ১০ বছরের মধ্যে সব কিছুতেই প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রত্যেকের হাতে এখন অ্যানড্রয়েড মোবাইল। মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও চাহিদার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে ডিজিটাল কমিউনিকেশন। আমাদের বহুল ব্যবহৃত একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো ফেসবুক। দেশে এখন ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসা গড়ে উঠেছে। ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবস্থায় ঘরে বসে নিজের ইচ্ছামতো খুব সহজে জিনিসপত্র কেনাবেচা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে চাকরি-পড়াশোনা হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে সরকারি কোনো সেবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সরকারি সব দপ্তরের টেন্ডার থেকে শুরু করে প্রাথমিক সব তথ্য মিলছে ওয়েবসাইটে। সেই সঙ্গে সরকারি সব তথ্য যাচাই-বাছাই ও সংরক্ষণ করা এবং এসব তথ্য গ্রহণ ও আবেদনের যাবতীয় কার্যক্রম থাকছে অনলাইনে। বিগত বছর প্রথমবারের মতো মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক থেকে শুরু করে দেশের বিচারিক কার্যক্রম এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও আলোচনা সব কিছুই হয়েছে অনলাইনে। পাসপোর্ট সেবা, ভোটার আইডি কার্ড বিষয়ক সেবা থেকে শুরু করে লকডাউনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পুলিশের অনুমতি পাসটির জন্যও এখন আবেদন করা যাচ্ছে অনলাইনে। দেশের যেকোনো প্রান্তে বসে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন করা যাচ্ছে। দেশে সরকারি কার্যক্রমের ৬০ শতাংশেরও বেশি সম্পন্ন হচ্ছে অনলাইনে। সেই সঙ্গে ভূমি বা জমিজমা বিষয়ক কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং গতি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় কার্যক্রমও অনলাইনে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।

সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও ডিজিটাইজেশনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকিংসেবা পৌঁছে গেছে প্রত্যেক গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজেই টাকা ট্রান্সফার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল, টেলিফোন বিল—সব ধরনের কাজই অনলাইনের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাচ্ছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের ব্যাংকের বর্তমানে নিজস্ব মোবাইল ব্যাংকিংসেবা রয়েছে। করোনাকালীন সুরক্ষার কথা চিন্তা করে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে করদাতাদের মধ্যে থাকা ভীতি দূর করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ এখন ঘরে বসে আয় করছে। ‘ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট’ ২০১৯-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে এরা প্রতিবছর ১০ কোটি ডলারেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। পৃথিবীতে যেসব দেশ ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে প্রথম দিকে। বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা ‘ফোর্বস’-এর জরিপে ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসা এই অর্থ আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে।

তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দোরগোড়ায় দ্রুত, স্বচ্ছতার সঙ্গে, হয়রানিমুক্ত ও স্বল্পমূল্যে সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক আধুনিক ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সরকারের প্রতিটি বিভাগের কার্যক্রমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি কমিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ‘রূপকল্প ২০২১’ আজ বাস্তবিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছে। সরকারের এটুআই (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) প্রজেক্টের মাধ্যমে তথা তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে জনগণ ঘরে বসেই এখন সেবা পাচ্ছে।

করোনা মহামারিতে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। এই মহামারি সামলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। গত ১০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামোর জন্যই এই মহামারি পরিস্থিতি আমরা ভালোভাবে সামলে যাচ্ছি।

করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য করোনাবিষয়ক তথ্যসেবা, টেলিমেডিসিন সেবা, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তা দ্রুত সময়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। শুধু শহরেই নয়, উপজেলা সদর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে এমনকি দুর্গম অঞ্চলেও তথ্য-প্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ৩৩৩-৫ হেল্পলাইনের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে জরুরি সেবা পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে কেউ আর অসহায় বোধ করবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে আছে শেখ হাসিনার গণমানুষের সরকার। জনগণের জন্য উন্মুক্ত এই নম্বরগুলো মূলত জাতীয় শক্তি ও নির্ভরতার প্রতীক। এই নম্বরগুলো জনগণের জীবনমান রক্ষা এবং দুর্যোগ পরিস্থিতির শক্তি।

এখন দেশের ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলায় পাঁচ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া হয়। প্রতারণা ও সহিংসতার শিকার হলে জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশের সেবা পাচ্ছি আমরা। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব বহন করছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অবদান রেখেছে। কোরবানি সামনে রেখে অনলাইনে পশু বেচাকেনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। যার মাধ্যমে জনসমাবেশ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। করোনাসংকট মোকাবেলায় সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে টিকাগ্রহীতাদের রেজিস্ট্রেশন, ফুড ফর নেশন, কল ফর নেশন, করোনা ট্রেসিং অ্যাপসহ নানা ধরনের ডিজিটাল সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে সরকার।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপই হচ্ছে আজকের আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর একটা আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সরকারপ্রধানের কাছে নিজের বঞ্চনা, অধিকার এবং প্রত্যাশার কথা বলতে পারেন। গণমানুষের নেত্রী হয়ে তিনি বাংলার মানুষের স্বপ্ন পূরণ করে যাচ্ছেন।

আমাদের পরম সৌভাগ্য, শেখ হাসিনার মতো সৎ, নির্ভীক, দরদি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহৎ মানুষকে আমরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মের সুযোগে আমি তাঁর প্রজ্ঞা ও মননকে দেখেছি; দেখেছি তাঁর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতা। পিতার আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও দর্শন। এই চেতনা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করে যাবেন—এই তাঁর প্রত্যয়। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক দৃষ্টি ও দার্শনিকতায় দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত সমাজ স্থাপন করেন। শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সেই উন্নততর সমাজের দীপ্তি ও দর্শন।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –