• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

বোচাগঞ্জে ঘানি ভাঙা তেল:বংশপরম্পরায় পেশা টিকিয়ে রেখেছে চার পরিবার

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২১  

কালের বিবর্তনে দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে কাঠের ঘানিতে ভেঙে তেল তৈরির প্রক্রিয়াটি। গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্যটি প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নিত্যনতুন যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের ফলে গ্রাম-বাংলার শত বছরের এ ঐতিহ্য ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। তবে আবেগের বশে তিন পুরুষের এ পেশা টিকিয়ে রেখেছে কিছু পরিবার। এমনি চার পরিবারকে খুঁজে পাওয়া গেছে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায়।

বোচাগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর নাফানগর ইউনিয়নের ছোট সুলতানপুর গ্রামে ৩ জন ও ৬ নম্বর রনগাঁও ইউনিয়নের কনুয়া গ্রামে ১ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়, যারা গরু দিয়ে টানা সরিষার তেলের ঘানি ভাঙছেন। 

সরেজমিনে এসব পরিবারের বাড়িতে গিয়ে শুনতে পাওয়া যায় গরু টানা ঘানির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। ঘানি টানার সময় গরুর চোখে বেঁধে দেওয়া হয় কাপড়। এই দৃশ্য দেখে মনে পড়ে গেল বইয়ে পড়া সেই ‘ঘানিটানা শ্রম’ আর ‘কলুর বলদ’-এর কথা। এসব ঘানির পেছনে দুই থেকে তিন-চারটি গরু থাকে। প্রতিবার পালা করে ঘানি টানে এরা। এসব গরুকে আগে শেখাতে হয়। না শেখালে ঘানি টানা যায় না।

ঘানি দিয়ে সরিষার তেল ভাঙানোর পরিবারগুলো বলছে, প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা, সরিষা ও গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এই পেশা ছেড়েছেন অনেকে। তবে এখনো দেশে-বিদেশে অনেকে সন্ধান করেন শতভাগ প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতায় তৈরি কাঠের ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল।

‘কলু’ বা ‌'তেলী', 'ঘানি' বা 'তেলের গাছ'- এই শব্দগুলোর সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মরে তেমন পরিচয় নেই বললেই চলে। আগে গ্রামে-গঞ্জে ও হাট-বাজারে মাটির হাঁড়িতে ফেরি করে বিক্রি হতো কাঠের ঘানিতে উৎপাদিত খাঁটি সরিষার তেল। হাঁড়ির ঢাকনির নিচে থাকত তালের বিচির খোসা দিয়ে বানানো বাঁশের হাতলের ওরং। তেল তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ওরং ব্যবহৃত হতো।

কলু হলো তেলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অর্থাৎ তেলী, আর বলদ হচ্ছে গরু। সরিষা বা তেলবীজ পেষার জন্য পশু দ্বারা চালিত যে দেশীয় যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয় সেটিই ‘ঘানি’ নামে পরচিতি। ঘানি টানার জন্য মূলত গরু কিংবা ঘোড়া ব্যবহার করা হয়। ঘানি তৈরি হয় কাঠ ও বাঁশ দিয়ে, যেখানে লোহার কোনো ছোঁয়া নেই। এটা তৈরি করতে রীতিমতো একটা গাছ লেগে যায়। একেকটি অংশ তৈরিতে লাগে একেকে ধরনের কাঠ। প্রত্যেকটি অংশের নামও ভিন্ন ভিন্ন। আট থেকে দশ ফুট লম্বা একটা কাণ্ডের অর্ধেকের বেশি থাকে মটিতে পোঁতা। ঘানির এটাই হলো প্রধান অংশ। এই অংশের নাম ‘গাছ’। পাকা কড়ই কাঠ সবচেয়ে উপযুক্ত এর জন্য। বিড়ালী, সেকারী, গুল্লা, ওড়া, শুয়া, জাইট, ডকো, কাতারি, জঙ্গাল ও পাতাড়ির সমন্বয়ে ঘানি বা তেলের গাছ তৈরি হয়।  

বিজ্ঞানের যুগে প্রযুক্তির বিপ্লবে দেশর প্রায় সব অঞ্চল থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে কাঠের ঘানিতে ভাঙ্গা তেল তৈরির প্রক্রিয়াটি। এখন তেল তৈরি হচ্ছে লোহার ঘানিতে। আর এই সরিষার তেল বাজর দখল করে নেওয়ায় ঘানি সরিষার তেলের স্বাদ পাচ্ছেনা মানুষ। 

বর্তমান সময়রে ব্যবসায়ীরা ইলেট্রিক মোটর দ্বারা লোহার ঘানিতে উৎপাদিত তেল কম দামে বিক্রি করতে পারলেও রাত-দিন পরিশ্রম করে গরু দিয়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোটায় ফোটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন করে সে দামে বিক্রি করতে পারেন না এই ব্যবসায়ীরা। এই যান্ত্রকি যুগে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ঐতহ্যিবাহী এখন বিলুপ্তির পথে। তাই এখন সচরাচর গরুর ঘানি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। তবে আবেগের বশে পত্রৈকি পেশা হিসাবে কেউ কেউ এখনো ঐতহ্যিবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন বোচাগঞ্জ উপজেলার এই চার জন্য পরিবার। তাদের বাড়ীতে গিয়ে কথা হয়।

উপজেলার ১ নম্বর নাফানগর ইউনিয়নের ছোট সুলতানপুর গ্রামের ( তেলী) বিজেন্দ্র নাথ বলেন, আমার বাবা পাকিস্তান আমল থেকে এই তেলের ব্যবসা করত। আমার বাবা পরলক গমন করারপর দুই চার বছর পরে আমি এই ব্যবসা শুরু করি। শীতকালে প্রচুর বিক্রয় হয়। গরমের দিনে একটু কম। আমার তেল বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। ঢাকা, বিদেশ সহ সেতাবগঞ্জ বাজারে বিক্রয় হয়।

একই গ্রামের ( তেলী) রাজেন চন্দ্র বলেন, আমার বাবা থেকে আমি তেল বাহা শুরু করি। আমার তেলের ব্যবসা করা পচিঁশ বছর হলো। প্রতি সোমবার করে সেতাবগঞ্জ হাটে বিক্রয় করি। বাড়ী থেকেও তেল বিক্রয় হয়। যার যেমন দরকার তারা তেমন নিয়ে যায়। কেউ কেউ পাঁচ কেজি পর্যন্ত বাড়ী থেকে তেল ক্রয় করে নিয়ে যায়। এখন ৪ শ টাকা করে কেজি তেল বিক্রয় করি। সব গরু দিয়ে তেল টানা যাবেনা। যেগুলো গরু চখ সেগুলো গরু দিয়ে যায়। সরাসরি ঘানিতে শেখা যাবেনা। আগে বাঁশ গারে জয়াল দিয়ে বাইরে শেখাতে হবে। শেখার পর ঘানিতে আনতে হবে। আমরা যে এটা ধরে আছি এটা বিশাল ব্যাপার। আগে বহুত তেলী ছিল। এখন মিল হওয়াতে একবারে বন্ধ।

একই গ্রামের (তেলী) বিষ্ণু পদ রায় বলেন, আমি ১৯৯০ সাল থেকে এই কাজটি করতেছি। আমি আমার বাবার কাছে শিখেছি। বাবা দাদুর কাছ থেকে শিখেছিল। বংশ পরস্পরায় আমাদের পরিবার এই তেলের ব্যবসা করে আসতেছে। ৫ কেজি সরিষা দিলে ১ কেজি ৫শ গ্রাম তেল হয়। আমি ছোট বেলা থেকে অনেক জায়গায় ঘানির তেল দেখেছি। এখন আর দেখিনা। আমাদের উপজেলায় মাত্র চারটি ঘানি আছে। আমরা এই চারজনে বাংলার ঐতিহ্য ধরে আছি।

৬ নম্বর রনগাঁও ইউনিয়নের কনুয়া গ্রামের ( তেলী ) মাসুদ রানা বলেন, আমি জন্ম থেকেই দেখেছি আমার দাদা তেলর গাছ বাহে। দাদা মারা যাওয়ার পর আমার আব্বা এই কাজটি ধরে। আব্বা অসুস্থ হওয়ার পর আমি দুই বছর ধরে করছি। আব্বা সব শেখায় দিছে। ৫ কেজি সরিষাতে ৬ থেকে সাড়ে ৬ পোয়া এর বেশী হয়না। 

সরিষা বা তেলবীজ পেষার জন্য পশু দ্বারা চালতি যে দেশীয় যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয় সেটিই ‘ঘানি’ নামে পরচিতি।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –