• সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২২ ১৪৩১

  • || ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

সাত বছর ধরে শিকলবন্দী নুর আলম

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৪  

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাসিন্দা নুর আলম। এলাকার আর কয়েকজন মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবন ছিল তার। একটি সাজানো সুখের সংসারও ছিল৷ পাথর উত্তোলন করে চলতো তার সংসার৷ তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ভারতের কারাগার থেকে ফিরেই হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। 

স্থানীয়দের ওপর হামলার অভিযোগে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ঘরের ভেতর শিকলবন্দী জীবন অতিবাহিত করছেন তিনি। 

নুর আলমের বৃদ্ধা মা নুর নেহা অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম চালাচ্ছেন সংসার৷ অর্থের অভাবে করতে পারছেন না সন্তানের চিকিৎসা।

জানা গেছে, মানসিক ভারসাম্যহীন নুর আলম জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ার সর্দাপাড়া এলাকার মৃত হকিকুল ইসলামের ছেলে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়,সর্দাপাড়া এলাকায় নুর নেহারের বাড়িতে তিনটি ঘর৷ বাড়ির একটি ঘরের দরজার একটু অদূরে বাম হাতে শিকল বেঁধে একটি সিমেন্টের পাকা খুঁটিতে বাঁধা রয়েছেন নুর আলম৷ কখনো বসে, আবার কখনো শুয়ে একটি কম্বল নিয়ে থাকছেন৷ তার আশপাশে কোনো মানুষ গেলেই তাদের পা ধরার চেষ্টা করছেন। চাচ্ছেন বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেতে। এই ঘরে তাকে দেয়া হচ্ছে খাবার৷ আর এভাবে এই ঘরেই ৭ বছর ধরে মানবেতর জীবন করছেন তিনি৷ 

স্থানীয়রা জানান,একটা সময় নুর আলম স্বাভাবিক জীবন পার করলেও এখন শিকলবন্দী জীবন তার। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এলাকাবাসীর ওপর হামলার অভিযোগে ৭ বছর ধরে নিজ ঘরেই শিকলবন্দী রয়েছেন তিনি। একদিকে দারিদ্র পরিবার অন্যদিকে নুর আলমের বন্দী জীবন। এতে করে মানবেতর জীবন যাপন করছে পুরো পরিবারটি।

পরিবার ও স্বজনরা জানান, বাবা মায়ের একমাত্র  সন্তান হওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন নুর আলম৷ জীবিকার তাগিদে বেছে নেন পাথর উত্তোলনের কাজ৷ তাই পাথর উত্তোলন করতে প্রতিদিন তেঁতুলিয়ার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মহানন্দা নদীতে গিয়ে তিনি নুড়ি পাথর উত্তোলনের কাজ করতেন। আর এতেই চলতো তার সংসার৷ পাথর উত্তোলন করার সময় হঠাৎ একদিন সীমান্ত অতিক্রম করার দায়ে নুর আলমকে আটক করে ভারতে নিয়ে যায় বিএসএফ। পরে ভারতে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাভোগের পর তিনি দেশে ফেরেন। দেশের ফিরে নিজ বাড়িতে এসেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন৷ পরে তার পরিবার তার চিকিৎসা করলেও তার পাগলামী বেড়ে যায়৷ স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজন এমন কী স্থানীয় মানুষের ওপর করেন হামলা। স্ত্রীকে দেখতে না পারায় বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন নুর আলমের স্ত্রী৷ নুর আলমের এমন পাগলামীর কারণে বাধ্য হয়ে মা নুর নেহার বাড়ির এক ঘরে হাতে শিকল বেঁধে রাখেন৷ দীর্ঘ ৭ বছর ধরে নুর আলম শিকলবন্দী জীবন যাপন করছেন৷ 

এদিকে বৃদ্ধ মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে নুর আলম ও তিন নাতনিকে নিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে দিন রাত পার করছেন৷ অর্থের অভাবে একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করাতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি৷ স্ত্রী থাকলেও নুর আলমের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে চলে যান৷ এছাড়াও নুর আলমের এক মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলেও বাবা নুর আলম অসুস্থতার কারণে বিয়ে দিতে পারছে না । 

স্থানীয়রা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে নুর আলম আবারো সুস্থ হয়ে উঠবেন। 

নুর আলমের বৃদ্ধা মা নুর নেহার বলেন, নুর আলম আগে সুস্থ ছিল। মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে বিএসএফ তাকে আটক করে। পরে তাকে ভারতের কারাগারে নিয়ে বন্দী করে রাখে৷ বাড়িতে  ফেরার পর সে আবোল তাবোল কথা বলতে থাকে। পরে এক পর্যায়ে পাগল হয়ে যায়৷ তার পেছনে অনেক টাাকা খরচ করেছি কিন্তু সুস্থ করতে পারিনি।  

তিনি আরো বলেন, আমি বৃদ্ধা মানুষ। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে আমার ছেলে ও তার সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি।  আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই যে,ছেলেকে ভালো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করাবো। তাই বাধ্য হয়ে আমার সন্তানকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। সন্তানের এমন করুণ পরিণতি ও মানবতের জীবন যাপন দেখে আর সহ্য করতে পারছি না৷ তাই আমার সন্তানের চিকিৎসার জন্য সরকার ও সমাজের সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি। 

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক ফেরদৌস আলম লিটন বলেন, আমার পাশের গ্রামের বাসিন্দা নুর আলম। তিনি দীর্ঘ সাত বছর ধরে শিকলবন্দী জীবন যাপন করছেন। তার মা ও সন্তানরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তার মা৷ সরকার কিংবা সমাজের বিত্তবান মানুষজন মানসিক ভারসাম্যহীন নুর আলমের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা করি। 

নুর আলমের প্রতিবেশী ফারুক হোসেন বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন নুর আলম আগে সুস্থ ছিলেন। পাথর তুলতে গিয়ে ভারতে আটকা পড়ে বাড়িতে ফেরার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা এলাকাবাসীরা অনেক সহযোগিতা করেছি কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য অনেক মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। তার মা গরিব মানুষ, মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। তাই সরকার যদি একটু সহযোগিতা করে তাহলে হয়তোবা নুর আলম সুস্থ হয়ে উঠবেন। 

এদিকে দারিদ্র পরিবারটির পাশে থেকে চিকিৎসার সহায়তা করার কথা জানান তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি।

তিনি বলেন, নুর আলম মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে শিকলবন্দী জীবন যাপন করছেন। তার বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থার বিষয়ে সহযোগিতা করার।  

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –