• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

জানাজা শেষ করেই পাকিস্তানি বাহিনীকে ধাওয়া করি

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০২১  

কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জ ভারত সীমান্তের খুব কাছাকাছি এলাকা। ভূরুঙ্গামারী থেকে বিতাড়িত হয়ে এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গাড়ে। গ্রামের মানুষদের ধরে এনে এখানকার ক্যাম্পে নির্যাতন শুরু করে। নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যা করে। দিনরাত কখনো রায়গঞ্জ ব্রিজের আশপাশে, নয়তো ক্যাম্পের পাশে সাধারণ মানুষের লাশ পড়ে থাকত। এ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে রায়গঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে শুরু হয় মিশন।

অনেক বড় অপারেশন। ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা। রাস্তাঘাট, ব্রিজ ওড়াতে হবে। বড় বড় গাছ ফেলতে হবে। যাতে পাকিস্তানি হায়েনার দল সামনে এগোতে না পারে। রাতের আঁধারেই তাদের ওপর আঘাত হানতে হবে। এ জন্য ছিল প্রচুর আর্টিলারি সাপোর্ট। সব প্রস্তুতি শেষ। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘরে যেতেই শুরু হয় ঝড়ের মতো গুলিবর্ষণ।

রায়গঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীদের লক্ষ্য করে তিন দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ চলতে থাকে। নিমেষেই পাকিস্তানি বাহিনীর কামান-গোলাবারুদ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। ভেঙে চুরমার হয় ক্যাম্প, স্কুল-হাসপাতাল। পাকিস্তানি সেনাদের অসংখ্য লাশ পড়ে। যুদ্ধরত অবস্থায় লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন দেশের জন্য। 

এটি কোনো গল্প নয়, মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে চষে বেড়ানো এক যুবকের জীবনকাহিনি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহবুবর রহমান। তার স্মৃতিতে ফুটে ওঠে তার যৌবনকালের মায়ের আঁচল ছেড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা। 

এই প্রতিবেদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বলেছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রংপুর জেলা ইউনিটের সাবেক সহকারী কমান্ডার (অর্থ) বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান।

স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছিল মাহবুবর রহমানের ৯ মাসের ঠিকানা। দেশকে মুক্ত করে বেঁচে ফিরে আসবেন, এমন স্বপ্ন দেখেননি কখনো। এ কারণে রণাঙ্গনে নিজের নাম তুলেছিলেন সুইসাইড স্কোয়াডে। শপথ নিয়েছিলেন শত্রুকে খতম করে তবেই মরবেন দেশের তরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা আর দুখিনী মায়ের অশ্রুসিক্ত আদেশ তার যুদ্ধে যাওয়ার পাথেয়।

বয়স তখনো বিশের কোঠা পার হয়নি। টগবটে তারুণ্য, উড়নচণ্ডী মন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে মিছিলে স্লোগানে থাকতেন সম্মুখসারিতে। তখন থেকেই সবার নজরে আসেন মাহবুবর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে রংপুরের। এর নেপথ্যে থেকে একটু একটু করে লড়তে থাকা অনেকের ভিড়ে মাহবুবরও ছিলেন তাদেরই একজন।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নেপথ্যের ঘটনা

একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের কথা স্মরণ হলে এখনো গায়ের লোম শিউরে ওঠে। রাত ১০টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে শুরু হলো গোলাগুলি। স্টেশনের বাবুপাড়া থেকে শুরু করে সারা শহরেই গোলাগুলির শব্দে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। বাতাসে বারুদের গন্ধ। কামানের মুখ থেকে বের হওয়া আগুনের ফুলকিতে আকাশ লাল। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। ভয়াল গ্রাসে সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করতে থাকে। পরের দিন শুক্রবার নিধুয়া পাথারে পরিণত হয় শহরের অলিগলি। লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকেন।

মাহবুবর রহমান বলেন, আমার বাবা-মা তারাও শহর ছেড়ে গ্রামে যাবার জন্য ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়ে। গরুর গাড়ি সাজিয়ে নিয়ে শহরের অদূরে গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টা গ্রামে চলে যায়। আমিও তাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। মনটা ছটফট করছিল। বিকেলেই গ্রামের মেঠোপথ ধরে একা হাঁটতে হাঁটতে আবার শহরে চলে আসি। শহরে ফিরে জানতে পারি তৎকালীন এমপি সিদ্দিক হোসেন ভাই ও খোন্দকার মুখতার ইলাহি আমাকে খুঁজতে এসেছিলেন। কারণ ২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে। আমরা এজন্য প্রস্তুতিও নিই।

২৮ মার্চ সকালবেলা কিছু লাঠিসোঁটা নিয়ে রিকশায় করে নিসবেতগঞ্জ হাটে যাই। একটি অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে কাঁপছিল। দেখতে দেখতে ১০টা বেজে গেল। রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে। তারপর অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে আসছেন। সবার হাতে বাঁশের লাঠি, ছুরি, বল্লম, কুড়াল, তির-ধনুক।

মুখে গগনবিদারী স্লোগান— ‘এসো ভাই অস্ত্র ধরো, ক্যান্টনমেন্ট দখল করো’। সেখানে শেখ আমজাদ হোসেন জ্বালাময়ী বক্তৃতা করলেন। তার বক্তব্য শেষ না হতেই মানুষজন লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক হাতে নিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিতে দিতে ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে চলল।
ঐতিহাসিক বালারখাইল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্ট মার্কেটের কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই এলোপাতাড়ি শুরু হয় গুলিবর্ষণ। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হন। সবাই দিগবিদিক ছুটতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট দখলের আশা ভঙ্গ হওয়ায় সেদিন জীবন হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। ওই ঘটনার পর থেকে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আতঙ্ক কাজ করছিল।

গজঘণ্টা গ্রামে গিয়েও ভয়ে বাড়িতে না থেকে টানা তিন-চার দিন মসজিদে ছিলাম। এরপর বাড়ির সবার সঙ্গে আবার গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসি। এর মধ্যে ৩ এপ্রিল দখিগঞ্জ শ্বশানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১১ জন নিরস্ত্র বাঙালিকে ধরে এনে একটা দড়িতে বেঁধে গুলি করে। এর মধ্যে একজন ছাড়া সবাই মারা যান।

৪ এপ্রিল বিকেলে ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম দিকে বখতিয়ারপুরে আগুন জ্বলছে। সেদিন ৭০ জন ইপিআর বাঙালিকে পাকিস্তানি হায়েনারা হত্যা করে। এর পরের দিন পরিবারসহ মাহবুবর রহমান নিজেই এক অঘটনের সম্মুখীন হন। তিনি ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ‘৫ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। ঘরের দরজা ভেঙে আমার দুই ভাবিকে টেনে হেচড়ে বাহিরে বের করে।

আমাকেও দরজা ভেঙে ঘর থেকে বের করে আঙিনায় নিয়ে আসে। তারা আমাদের দিকে বন্দুকের নল তাক করে ধরে ছিল। তখন হঠাৎ এক সেনা কর্মকর্তা আমাকে ছেড়ে দিতে বললেন। আমি অবাক হয়ে মাথা তুলে দেখি, আমার পূর্বপরিচিত একজন সৈন্য। তার সঙ্গে ছোটবেলা খেলাধুলা করেছি। আমাদের সবাইকে এ যাত্রায় ছেড়ে দিয়ে চলে যান তারা।’
 
এ ঘটনার পর মাহবুবরকে তার মা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু দেখতে চাননি তিনি। তাই সেদিন তাকে যুদ্ধে যাওয়ার হুকুম দেন।

মাহবুবর রহমান বলেন, আমি সেদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বারবার বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দগুলো কানে বাজছিল। এদিকে মায়ের হুকুম আমাকে আরও সাহসী করে তোলে। শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গাচড়ার মহিপুর ঘাটের দিকে চলে যাই। সেই যাত্রাপথে অনেক লোকজন ছিল। তখনো জানতাম না কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থাকব, কী হতে যাচ্ছে। মহিপুর ঘাটে গিয়ে অনেক বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতের সাথে দেখা হয়। তাদের সাথে সন্ধ্যায় ভারতের শিতাই পৌঁছে যাই।

কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং

শিতাইতে গিয়ে দেখা হয় হারেস উদ্দিন সরকারের (বীর প্রতীক) সাথে। তাকে রংপুরের পরিস্থিতির কথা অবগত করেন তিনি। তাকে এ কথাও বলেন, আমি মরতে এসেছি, জীবন বাঁচাতে নয়। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। আমাকে অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেন। আমি একাই রংপুর আক্রমণ করব।’ এ কথা শোনার কয়েক দিন পর মাহবুবরকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণে সুযোগ করে দেন হারেস উদ্দিন সরকার।

ঢাকা পোস্টকে মাহবুবর বলেন, আমি প্রথমে জাওরানি ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছি। এরপর বিএসএফ ক্যাম্পে আরেকটি ট্রেনিংয়ের সুযোগ হয়। সেখানে তিন-চার সপ্তাহ ধরে অস্ত্র চালানো থেকে শুরু করে আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল শেখানো হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। পরে সরকারি উদ্যোগে আমাদের প্রথম ব্যাচ হিসেবে মূর্তি ক্যান্টনমেন্টে (পরবর্তীতে মুজিব ক্যাম্প) ডেকে নেওয়া হয়। এক মাসের ট্রেনিং শেষে আমরা মাঠে ফিরে আসি। পরবর্তীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং এক মাস ইন্সপেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করি। আমার সাথে অনেকেই ট্রেনিং নেন, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালও ছিলেন।

মাহবুবর যুদ্ধক্ষেত্র ও সেক্টর

দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে ৬ নং সেক্টরে যোগ দেন মাহবুবর রহমান। ইউং কমান্ডার এমকে বাশার সেক্টর নং ৬-এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৫টি সাব-সেক্টর ছিল এ সেক্টরের অধীনে। ৬ নং সেক্টরের সদর দফতর ছিল বুড়িমারী পাটগ্রাম। দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহাকুমা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রংপুর নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেক্টর ৬ নং।

মাহবুবর রহমানের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র ছিল হিমকুমারী। ডোমার, ডিমলা ও চিলাহাটি নিয়ে ওই এলাকাটা ছিল। সেখানে পৌঁছানোর তিন দিন পরই অপারেশন চালিয়ে চিলাহাটি রেলওয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। তারপর গোমনাতি বিউপি আক্রমণ করেন।

পরে মাহাতাব সরকার (বীর প্রতীক) নামের এক সহযোদ্ধার সাথে রংপুরে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল রংপুরের খবরাখবর নিয়ে শিতাই ফিরে যাওয়া। সবকিছু জেনেশুনে শিতাই ফেরার পর দেড় মাস শিথলখুঁচিতে ছিলেন তিনি। এ সময় সেখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিনি সুইসাইড স্কোয়াডে তার নাম দেন। 

মাহবুবর রহমান আরও বলেন, দ্বিতীয়বার রংপুরে এসে আমার ইচ্ছে ছিল বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর। আমার সঙ্গে সৈয়দপুরের তৈয়বুর রহমান মন্টু ছিলেন। আমরা রংপুরে আসার সময় কিছু গোলাবারুদ নিয়ে এসেছিলাম। শহরের দমদমা ব্রিজ, জাফরগঞ্জ ব্রিজ নয়তো কোনো একটা রেলওয়ে বিজ্র উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু রাজাকারদের অস্ত্রসহ কড়াপাহাড়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

আমাদের সঙ্গে তখন কোনো অস্ত্রও ছিল না। শেষে আমরা নতুন পরিকল্পনা করি। পিডিবির পাওয়ার সাপ্লাই স্টেশনে হামলা চালিয়ে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ করতে সক্ষম হই। সেদিন ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণে পুরো রংপুর যেন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল। রাত দুইটার পর থেকে পুরো শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বলে জানান তিনি।

যে স্মৃতি এখনো কাঁদায়

বিদ্যুৎ অফিসের ট্রান্সফরমার বিকলের অভিযান সফল হলে এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে আসেন মাহবুবর। তার সহযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান তখন সৈয়দুপুরে যান। সাত দিন পর ফিরে এসে নতুন কোথাও বড় ধরনের আঘাত হানার ছক আঁকাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

আমি বড় বোনের বাড়িতে যাই। আমাকে দেখে আমার বোন চিনতে পারেনি, হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন আমার শরীরের অবস্থাও বেশ নাজুক। পরনের কাপড় থেকে দুর্গন্ধ ছুটছিল। আমার ভাগ্নি মনোয়ারা নিজ হাতে আমাকে কুয়ারপাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে সুগন্ধি সাবানে ঘণ্টাখানেক ধরে ভালো করে গোসল করিয়ে দেন। কতদিন পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে পেরেছিলাম, তা মনে নেই। কিন্তু সেদিন আমার মনের মধ্যে যেন বেহেস্তের সুখ অনুভব হয়েছিল, মাহবুবর বলেন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, ওই দিনই ভাগ্নি মনোয়ারার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। যুদ্ধের পর আর তাকে দেখিনি। মনোয়ারা ভীষণ সুন্দরী ছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা আমার ভাগ্নিকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমাদের পরিবারের অনেককেই আমরা হরিয়েছি। কিন্তু ভাগ্নির কথা খুব বেশি মনে পড়ে। কারণ কুয়ারপাড়ে আমাকে গোসল করিয়ে দেবার সময় মনোয়ারা বাংলাদেশকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের কথা বলেছিল, যা আমার কানে এখনো ভাসে।

রংপুরে থাকা অবস্থায় একদিন লুকিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে প্রবেশ করি। তখন আমাকে কেউ ধরলে আমি তাকে মেরে তারপর মরতাম, এই জিদ আর সাহসটা বুকে ছিল। ভয়হীন চিত্তে ভেতরে ঢুকে হাঁটতে গিয়ে থমকে যাই। চোখে পড়ে খালে, জঙ্গলে, গর্তে হাজার হাজার মানুষের লাশ। কোথাও একসাথে ৫০ থেকে ৬০ জনকে একসঙ্গে বেঁধে গুলি করেছে। কোথাও আবার লাশের ওপর লাশ পড়ে আছে। আমি সেদিন হতবম্ব হয়ে যাই। আমরা মানুষকে বাঁচানোর জন্য, দেশের মাটি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতেছি। আর পাকিস্তান বাহিনী হাজার হাজার মানুষকে ধরে এনে এভাবে হত্যা করছে! চোখের সামনে সেদিনের ওই দৃশ্য এখনো ভেসে উঠলে এখনো আঁতকে উঠি।

রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতি

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর উপজেলার রায়গঞ্জে সবচেয়ে বড় এবং স্মরণীয় একটি অপারেশন চালানোর স্মৃতি তুলে ধরেন মাহবুবর রহমান। তিনি বলেন, সব সময়ই যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলাম। ভারতের সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জোশির নির্দেশনায় আমরা রায়গঞ্জে একটা বড় অপারেশনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার কাজ ছিল রাস্তা ব্লক করা। রাস্তা ওড়ানোর কাজে সহযোগিতার জন্য আমার পেছনে আরও ৩০ জন ছিল।

অন্যদিকে আমাদের আক্রমণভাগে ছিল লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ (বীর উত্তম)। যাতে পাকিস্তান বাহিনীর কেউ পালাতে না পারে। আমরা রাস্তা ব্রিজ ভেঙে দিয়ে অ্যাম্বুশ নিয়ে থাকি। প্রচুর আর্টিলারি সাপোর্ট ছিল।

রাত ১২টার পর আমাদের সব দিক থেকে ঝড়ের মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সেখানে ১২০ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যান। এটা আমার দেখা বড় যুদ্ধ বা আক্রমণ ছিল। সেখানে আমাদের লেফটেন্যান্ট সামাদও শহীদ হন। পরের দিন ২০ নভেম্বর ঈদের নামাজে সামাদের জানাজা শেষ করেই আমরা আবার গাড়ি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ধাওয়া করি।

মাহবুবরের দাবি, ওই যুদ্ধ ২১ নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। যৌথ বাহিনী রায়গঞ্জ দখল করে। পরে শহীদ সামাদের লাশ উদ্ধার করে করবস্থ করা হয়। ২৭ নভেম্বর ব্যাপারীহাটে হায়েনা বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আবার যুদ্ধ বাধে। ২৮ নভেম্বর তুমুল যুদ্ধের পর নাগেশ্বরীর পতন ঘটে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরলা পার হয়ে কুড়িগ্রামের দিকে পিছু হটে। মুক্ত হয় উত্তর ধরলার সব রণাঙ্গন।

সহযোদ্ধাদের স্মৃতি ভুলতে পারেননি

মুজিব বাহিনীর ৬ নং সেক্টরের প্রধান মুখতার ইলাহীর সাথে বড় বড় হামলার বিষয়ে মাহবুবর রহমান পরিকল্পনা করেছিলেন। কারমাইকেল কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন মুখতার ইলাহী। রংপুরে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন-সংগ্রামে অনেক অবদান তুখোড় এই ছাত্র নেতার। খোন্দকার মুখতার ইলাহী রংপুরে এসে মাহবুবরের বাড়িতে অনেকগুলো অস্ত্র রেখেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথে লালমনিরহাটের বড়বাড়িতে ধরা পড়েন তিনি। প্রায় ৪০০ পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর মিলে বহু মানুষকে একসঙ্গে জড়ে করে। পরে ১১৯ জনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেখানে মুখতার ইলাহীও শহীদ হন। সেদিন ছিল ৯ নভেম্বর।

লেফটেন্যান্ট সামাদ, শেখ কামাল, মাহাতাব সরকার, তাজির উদ্দিন, তৈয়মুর রহমান, বশিরসহ অনেকেই ছিলেন তার সহযোদ্ধা। যাদের কথা এখনো তিনি ভুলতে পারেননি। অনেকের সাথে ট্রেনিংয়ে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে জমে থাকা খুনসুটিও তাকে কখনো ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। আবার কখনো করে তোলে অশ্রুসিক্ত।

শেখ কামালের সাথে তার নিজের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের মধ্যে যুদ্ধকৌশল, মনোবল ও প্রচুর সাহস ছিল। তার আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমের দৃঢ়তা ছিল প্রসংশনীয়। প্রশিক্ষণের সময়ে খুব কাছ থেকে তাকে জানার সুযোগ হয়। এতে ঘনিষ্ঠ ভাব হয়েছিল। তিনি তার বাবার মতো দৃঢ়চেতা মনের মানুষ ছিলেন।

পোলাও-মাংস রান্না করে আতিথেয়তা

সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হতো না দাবি করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সাধারণ মানুষই আমাকে বেশি খবর দিতেন। কোথায় পাকিস্তান বাহিনীর সৈন্য আছে, কোন দিকে তাদের গাড়ি যায়, রাজাকাররা কী করছে, এসব তথ্য আমি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জেনেছি। সাধারণ মানুষরাই মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি রক্ষা করেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা কখনো বিপদে পড়লে গোয়াল ঘরে, গর্ত করে বাঙ্কারে নয়তো পাটখড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিত। অনেকেই পোলাও-মাংসসহ ভালো ভালো খাবার রান্না করে খাওয়াতো। সাধারণ মানুষের এই আতিথেয়তা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে যখন তাদের কারও মৃত্যু ও কষ্ট হতো, তা দেখলে আমি ভীষণ ব্যথা পেতাম। সাধারণ মানুষ যুদ্ধের সময়ে শুধুই মৃত্যুভীতি নিয়ে নীরবে বাড়িতে থাকতেন। সব সময় তাদের মধ্যে হাহুতাশ কাজ করত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হতো না।

মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তিস্বীকার

মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই উল্লেখ করে মাহবুবর রহমান বলেন, ’৭৫-পরবর্তী আমরা নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে পারিনি। যে মানুষ, মাটি ও দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, সে দেশেই আমরা অরক্ষিত হয়ে পড়ি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের শাসনভার নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, যখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা-বিরোধী আন্দোলন হয়, তখন আর কিছুই বলার থাকে না। সরকার আমাদের ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দেয়। এটা দেখে অনেকের শরীর জ্বালাতন করে। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা নেই। এখনকার রাজনীতিবিদদের ছেলে-মেয়েরাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না। এই ব্যথা কাঁদায়, আমরা কাঁদি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রংপুর জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, রংপুরের আট উপজেলা ও মহানগর মিলে জেলায় মুক্তিযোদ্ধা ১ হাজার ৪০০ জন। এর মধ্যে ৯৫ ভাগ ভাতা পেয়ে আসছেন। এছাড়া দুটি কমপ্লেক্স ভবনের মার্কেট থেকে প্রাপ্ত টাকাও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমানভাগে বণ্টন করা হয়। পাশাপাশি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ কার্যক্রম রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার করোনাকালে আমাদের ভাতা বাড়িয়েছে। গৃহহীন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, মাহবুবর রহমান ১৯৫০ সালের ১৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কৃষক মৃত কফিল উদ্দিন, মা মৃত মফিজন নেছা। মা-বাবার সংসারে ১২ ভাই-বোনের মধ্যে মাহবুবর রহমান ছিলেন কনিষ্ঠ। বর্তমানে বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তিনি রংপুর নগরের ধাপ হাজীপাড়া এলাকার বসবাস করছেন।

মাহবুবর রহমান ১৯৭০ সালে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত হন। তবে তা বেশি দিন করেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা ও মায়ের আদেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীনের পর ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বেতার ও মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেন। তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –