• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

সংগ্রামী প্রান্তিকের নেতা

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২১  

আফসান চৌধুরী

বাঙালি ও মুসলমান – এই দুই পরিচয়ের মধ্যেও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি এই দেশের সকল মানুষের সকল জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। তবে যাদের কথা তিনি সবচেয়ে বেশি শিরোধার্য করেছিলেন, তারা হলেন এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। অথবা বিশ-পঁচিশ বছরের আন্দোলনের ফলও নয়। আমরা শেখ মুজিবকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাকে কিছুটা বৃত্তে আবদ্ধ করে ফেলি। আমরা তাকে বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতা হিসেবে দেখি। কিন্তু তার পরিচিতি এর চেয়ে অনেক বড়।

বাঙালি ও মুসলমান – এই দুই পরিচয়ের মধ্যেও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি এই দেশের সকল মানুষের সকল জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। তবে যাদের কথা তিনি সবচেয়ে বেশি শিরোধার্য করেছিলেন, তারা হলেন এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী প্রান্তিক হয়ে যায়। কখনও তারা হিন্দু কখনও তারা অন্য কিছু। সেই কারণেই বিভিন্ন সময় যারা প্রান্তিক হয়েছেন, শেখ মুজিব তাদের পক্ষে গেছেন। প্রান্তিক মানুষের পক্ষের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, তবে দেখব, যে শ্রেণি থেকে তিনি প্রান্তিক মানুষের আন্দোলনের নেতৃত্বে এসেছেন, সেই শ্রেণির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু তিনি নিজে প্রান্তিক ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু যা করতে চেষ্টা করেছিলেন, তা হলো, সামগ্রিকভাবে এমন একটি মূলধারা তৈরি করা, যেখানে সকল স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিকামী সকল সামাজিক শক্তি একত্রিত হতে পারবে এবং একটা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করবে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা কিন্তু এক দিনের নয়। শেখ মুজিবের দলীয় রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সাল থেকে। পূর্ববঙ্গের যে রাজনীতি, সে রাজনীতিরই প্রতিনিধিত্ব করেন শেখ মুজিব। তিনি ১৯৪৭ সালেও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তবে তখন ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মতো অন্যান্য নেতাও ছিলেন।

গোপালগঞ্জে যাত্রা শুরু

আমি মনে করি, শেখ মুজিবুর রহমানের যে গুরুত্ব, তা রয়েছে গোপালগঞ্জের ইতিহাসের মধ্যে। ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দি ও ফজলুল হকের দেখা হয়। তারা একটা মিটিং করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসের লোকজন মিটিংটা হতে দিচ্ছিল না। তখন শেখ মুজিব তার সহকর্মীদের সাহায্যে মিটিংটা সফলভাবে করেন।

এই যে প্রতিবাদ, এ বিষয়টা আমরা লক্ষ্য করি না। আমরা কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক চোখ দিয়ে শেখ মুজিবকে দেখি। তার আত্মজীবনী পড়লে জানা যায় শেখ মুজিবের সঙ্গে সামাজিকভাবে দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছিল। শেখ মুজিব প্রথম যখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন, সেটাও ছিল সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে। একদল আক্রমণ করতে এসেছিল, তিনি লাঠি দিয়ে আক্রমণকারীদের একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। এমন একজন সবল ও প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন শেখ মুজিব।

এ রাজনীতির পরিবেশটা দেখা দরকার সর্বভারতীয় রাজনীতির চোখ দিয়ে। বাংলাদেশে কোনোদিন সর্বভারতীয় রাজনীতি প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশে সর্বভারতীয়তা বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ উত্তর ভারতীয় যে রাজনীতি, তা এসেছে দখলদার হিসেবে। বাংলাদেশের সাথে উত্তর ভারতে সম্পর্ক দখলদার-দখলকৃতের বাইরে আর কিছু ছিল না। সে দখলদার আর্যরা হোক বা মোঘলরা হোক বা পাকিস্তানিরাই হোক। পাকিস্তানও উত্তর ভারতেরই অংশ। অতএব এই যে প্রান্তিক আর কেন্দ্র, এটা আমার কাছে মনে হয় বঙ্গবন্ধু বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কম আলোচিত।

প্রান্তিক মানুষের ভূমিকা

শেখ মুজিবের যে রাজনীতি, সেটা বুঝতে হলে আমাদের প্রান্তিক মানুষের ভূমিকা বুঝতে হবে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের দখলের পরে প্রথম আন্দোলন করেছে প্রান্তিক মানুষেরা। সেই প্রান্তিক মানুষদের সামনে ছিল ফকির-সন্ন্যাসীরা, যাদের খাজনা দেবার অধিকার ইংরেজরা কেড়ে নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু মূল শক্তিটা এসেছে কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে। কৃষকশ্রেণী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হিসেবে ইতিহাসে বারবার আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।

এ ধারাবাহিকতা ১৭৬০-১৮৫৭ এর আন্দোলনগুলোয় ক্রমাগতভাবে চলে এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম কথিত হলো কৃষকের আন্দোলনের ইতিহাস। এটাকে বাদ দিয়ে আমরা ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্ট পড়ি, বেঙ্গল রেনেসাঁস পড়ি। কলকাতার যে দালালি সংস্কৃতি, ব্যবসা সংস্কৃতি, জমিদার সংস্কৃতি - সেগুলোর চর্চা করি আমরা। এই সংস্কৃতি ও এই ইতিহাসের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি কোনোভাবেই মিলতে পারে না। তিনি কোনোদিন দালালিকে গ্রহণ করেন নি, কোনোদিন নিজের সুবিধার জন্য দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি।

ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন থেকে এটা বোঝা যায়। ফকির ও সন্ন্যাসীদের খাজনা দিত গ্রামের মানুষ। মুসলমানরা ফকিরকে দিত ও হিন্দুরা সন্ন্যাসীকে দিত। অতএব দুটি জনগোষ্ঠীর একসাথে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। এই পরিবর্তনটা শুরু হয় ১৭৯৩ সালের পরে যখন জমিদারি ব্যবস্থা অনেকটা সবল হয়ে যায়। এর আগে ১৭৬০-১৭৯৩ পর্যন্ত ৩৩ বছরে অনেক আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনগুলো হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে করেছে। কিন্তু ১৭৯৩ এর পর থেকে এটা কমতে থাকে। বাংলার হিন্দু মধ্য ও উচ্চবিত্তরা নিজেদের আলাদা করতে থাকে। এর কারণ তারা ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখানকার, অর্থাৎ পূর্ববাংলার, মুসলমান জনগোষ্ঠীদের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না। আর যারা ছিল, তারা বাংলার মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। অতএব তাদের দালালি করার সুযোগ কম ছিল। এটাও ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

ফরায়েজী আন্দোলনে দেখা যায়, সৌদি আরবের ওহাবি আন্দোলন থেকে শিখে এসে এখানে বলছে যে, এদেশের মানুষেরা মুসলমান নয়। তারা হিন্দু জমিদারদের আক্রমণ করছে এবং বলছে, এদেশের মুসলমানরাও মুসলমান না। কিন্তু তারা যখন যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, তখন সেই মুসলমান প্রজাদেরই সহায়তা নিচ্ছে, যাদের মুসলমান বলতেও তারা রাজি ছিল না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যে-ই প্রতিবাদ করুক, যে-ই আন্দোলন করুক, কৃষকের সহায়তা তাদের নিতেই হয়। অতএব কৃষকই ইতিহাস পাল্টানোর প্রধান শক্তি।

১৮৫৭ সালের পরে সর্বভারতীয়ভাবে মুসলমান মধ্যবিত্ত তৈরি শুরু হলো। কৃষকেরা তখন এতটাই শক্তি প্রয়োগ করতে পারছে যে তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাথে প্রতিযোগিতায় নামে, যার ফলে ইংরেজদের ওপরে চাপ বেড়ে যায়।

ইংরেজদের ভূমি সংস্কার আইনের ইতিহাস দেখলে জানা যায়, খুব অদ্ভুতভাবে ইংরেজরা উনিশ শতকের শুরু থেকেই কৃষকদের কিছু সুবিধা দেবার চেষ্টা করেছে। এর কারণ হলো জমিদাররা ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য দেখানো ছাড়া আর কিছু করেনি। জমিদারি ব্যবস্থা অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই ব্যর্থ ছিল।

এ কারণে ১৮১১ সালে পত্তনি প্রথা তৈরি হলো। পত্তনি প্রথার মাধ্যমে নতুন এক শ্রেণি তৈরি হলো। তারা হলো মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি। এই মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি একটা বড় ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে। কারণ সে কৃষককে জানে, আবার জমিদারকেও জানে। মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে সে দুইদিকে খেলছে। এই সুবিধা নিয়ে মধ্য শ্রেণির কৃষক, জোতদারশ্রেণি, তালুকদার এরা সবল হয়ে গেল। এই সবলতার কারণে তারা রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করল। তাদের শক্তিও বেড়ে চলল। ইংরেজরা ভাবল এদের সামাল দিতে হলে কিছু সুবিধা দিতে হবে, সমঝোতা করতে হবে। অতএব ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ।

বঙ্গভঙ্গ একটা উপরাষ্ট্র

বঙ্গভঙ্গকে আমার মনে হয় একটা উপরাষ্ট্র, যা আমাদের আজকের বাংলাদেশের ভৌগোলিক সূত্র। এখানে ইংরেজরা যেমন কলকাতার প্রভাবকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে, তেমনভাবে মুসলমানদের যে দালালশ্রেণি ছিল, বলা যায় সুবিধাভোগী শ্রেণি, তাদের সুবিধা দিতে চেষ্টা করেছে। তাই তাদেরকে সামাল দেয়ার একটা চেষ্টা ছিল। একই সাথে যে কথাটা একেবারেই উচ্চারিত হয় না, কৃষক সমাজকেও তারা খুশি করার চেষ্টা করেছে। কৃষকরা ছিল জঙ্গি ও প্রতিবাদী। কৃষকরা ছিল বঙ্গভঙ্গের পক্ষে।

পূর্ববঙ্গ যদি আলাদা হয়ে যায়, কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে জমিদার, পাওনাদারদের কেউই সবল অবস্থায় থাকতে পারবে না। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতার বাবুসমাজ প্রতিবাদ করে স্বদেশী আন্দোলন করে।

কৃষকেরা স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। পরবর্তীকালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলো, কৃষক এর প্রতিবাদ করে আন্দোলন করেছে। এই যে দুইটা বঙ্গ – পূর্ব ও পশ্চিম, তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে ১৯০৫-১৯১১ সালের মধ্যে। তখন রাজনীতি কেন্দ্রীয় হয়ে গেল অর্থাৎ দিল্লির হাতে চলে গেল। এর পরের ঘটনা ১৯২৩-১৯২৪ সালের।

১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট এই উঠতি শ্রেণিদের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু এর প্রতিবাদ করল মধ্যবিত্ত হিন্দু শ্রেণি। কারণ তারা তাদের সুবিধা ছেড়ে দিতে নারাজ। এই চেষ্টাটা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯১১ সালের পরে কোনো যৌথ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ১৯০৯ সালে কৃষক যখন ভোটাধিকার পেল, তখন পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কারণ কৃষক যাকে পছন্দ করে না, সে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরাই ক্ষমতায় এল। তারা হলো মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি। এই পরিবর্তনের মানেই হলো উপরাষ্ট্র রাজনীতির প্রতিষ্ঠানিকরণ।

লাহোর প্রস্তাব ও বাংলাদেশ

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে যখন বলা হচ্ছে ‘একটা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে’ তখন বঙ্গের যে চিত্র ছিল, তার সঙ্গে সর্বভারতীয় ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগের’ চিত্র এক নয়, তারা একই মানুষ নয়। এই পার্থক্যটা অনেক মানুষ লক্ষ্য করেন না। তারা পাকিস্তানের বিরোধিতা করতে গিয়ে সকল মানুষকে এক ধরনের ‘পাকিস্তানি’ মনে করেন। এটা আমার মতে একটা ভ্রান্তি।

১৯৪০-১৯৪৬ পর্যন্ত একই রকম অবস্থা ছিল। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পরে জিন্নাহ দেখল যে সব ভোট তাদের বাক্সে। যারা বিরোধিতা করেছিল, এমনকি ফজলুল হকসহ অন্য নেতারা, তারা তাদের দলসহ সম্পূর্ণরূপে ধুলিস্যাত হয়ে যায়। জিন্নাহ তখন ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অস্বীকার করে বললেন ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের’ বিষয়টা টাইপিং ত্রুটি ছিল, আমার মনে হয় জিন্নাহ অসততা করেছেন। কারণ ১৯৪০-১৯৪৬ পর্যন্ত বহু বার ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের’ কথা আলোচিত হয়েছে। ভুল থাকলে তখনই তো কথাটা উঠত। আমি মনে করি জিন্নাহের এই অসততার সবচেয়ে বড় দাম দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালে।

১৯৪৬-১৯৪৭ এর সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণরা খুব ক্ষুব্ধ ছিল। এই ক্ষুব্ধ তরুণদের একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন আন্দোলন করছেন, বস্তি পাহারা দিচ্ছেন, যেন দাঙ্গাকারীরা আক্রমণ করতে না পারে। এই বস্তির গরিব মানুষগুলোর সঙ্গে, পূর্ব বাংলার প্রান্তিক মানুষগুলোর সঙ্গে শেখ সাহেবের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

৪০-এর দশকেই আমাদের স্বাধীনতার সূত্রপাত

১৯৪৭ সালে আবুল হাশিম প্রস্তাব দিলেন, আমরা আলাদা বাংলা করব। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব মুসলিম লীগ করেনি, করেছে কংগ্রেস। নেহেরুর চাপে যৌথ বঙ্গ আন্দোলন ধ্বংস হয়েছে। পাকিস্তান-ভারতের বাইরে আমরা হচ্ছি তৃতীয় বাস্তবতা। আমরা আলাদা হয়েছি, স্বাধীন হয়েছি ঊনিশশ চল্লিশেই।

১৯৪৭ সালে ‘ইনার গ্রুপ’ নামের ছোট একটা দল ছিল, যারা স্বাধীন দেশ চাইছিল। সে দলের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী। তিনি মুসলিম লীগ করতেন ও শেখ সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যখন মিটিং করতাম, শেখ সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছিল।’ আমি আবারও বলছি পাকিস্তান তখনও হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলেন। যে মানুষটা ভাবতেন পূর্ব পাকিস্তান একটা কলোনি হবে, সেই শেখ মুজিবকে আমরা পাকিস্তানি বানাই কী করে? শেখ সাহেব কখনওই পাকিস্তানি ছিলেন না।

এই ধারাবাহিকতায় ’৪৭-এর পরে ’৪৮-এ ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। আন্দোলন এতটাই তীব্র হলো যে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ ধুলিস্যাত হয়ে গেল। ’৫২ তে গোলাগোলি পর্যন্ত হলো। ’৫০-এ ভুখা মিছিল হয়েছে।

২০০ বছরের আন্দোলন

আমাদের একটা ‘পাকিস্তানি’ মনোভাব আছে। এই মনোভাবের কারণে আমরা মনে করি ১৯৪৭ এর পরে যে আন্দোলন হয়, সেখান থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু তা নয়। এটা দীর্ঘ ২০০ বছরের সংগ্রাম। আমার মতে, এর চরম মুহূর্তটা ৭ মার্চের ভাষণ। ওইদিন বিক্ষুব্ধ শেখ সাহেব বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’।

এই কথার বয়স ২০০ বছর। স্বাধীনতা-মুক্তি কোনো আইনি বিষয় নয়। এটা জনগণের সংগ্রাম।

শেখ সাহেবের কোনো কিছু বলার দরকার ছিল না। বাংলাদেশ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়েছে। ১৯৭১ সালেও কৃষকরা তাদের ১০০ ভাগ সমর্থন দিয়েছে। কৃষক এই যুদ্ধটা ধারণ করেছে, লালন করেছে, কারণ এটা ছিল তার ঐতিহাসিক সন্ধান। এ ঐতিহাসিক সন্ধানের নেতৃত্বস্থানীয় হিসেবে তারা শেখ মুজিবকে দেখেছে। অন্য আরও অনেকেই ছিলেন, তবে মূল নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবকে ভাষা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে বা রাজনৈতিক দল দিয়ে বৃত্তাবদ্ধ করা যাবে না। তিনি একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন, যেটা ছিল প্রান্তিক মানুষের আহ্বান। এ প্রান্তিক মানুষের নেতৃত্ব দেবার অধিকার তার ছিল বলেই সে মানুষেরা তাকে গ্রহণ করেছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশ যে তিনটা রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, তার বাস্তবতা তিন রকম। পাকিস্তান হয়েছে একটা সামরিক রাষ্ট্র, ভারত হয়েছে একটা উপনিবেশিক এলিট রাষ্ট্র ও বাংলাদেশ হয়েছে একটা গ্রামীণ কাঠামোর রাষ্ট্র। এটা সম্ভব হয়েছে এই নেতৃত্বের কারণে, জনগণের কারণে। জনগণ আর নেতৃত্ব যখন এক হয়, তখন এই ধরনের রাষ্ট্র জন্মানো সম্ভব।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –