• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

বীভৎস গণহত্যার গল্প

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২০  

কোনো দেশ আক্রমণ করতে হলে কিছু নিয়ম কানুন অনুসরণ করতে হয়। প্রবাদে আছে প্রেমে ও রণে কিছুই অন্যায় নয়। কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে আক্রমণ করতে হলে আগে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তদানিন্তন পাকিস্তান সরকার গায়ের জোরে অতর্কিত নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী কোনোভাবেই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ করা যাবে না। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাতকে বাঙালি জাতি ঘৃণার সাথে স্মরণে রাখবে। এদেশে জনরোষই জনযুদ্ধের সূচনা করেছিল। 

আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতিতে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করার পদ্ধতি তাদের ভালোভাবেই জানা। অন্যদিকে চীন অনুসারী পশ্চিম পাকিস্তানিরা বন্দুকের নলে বিশ্বাসী। বন্দুকের নল দিয়ে দীর্ঘ চব্বিশ বছর একটি দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল তারা। শাসন ও শোষণ করেছে অযৌক্তিক উপায়ে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে তদানিন্তন পূর্ব বাংলার বাঙালি জনমনে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে আমজনতাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। 

এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ”। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার এ ঘোষণা পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি চ্যালেঞ্জ ও হুংকার ছিল-“আর যদি আমার মানুষের উপর একটি গুলি চলে, তোমাদের উপর নির্দেশ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো”। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ পাকিস্তান সরকারের গোস্যাকে চরমে তুলে দিয়েছিল।
 
মিছিল মানে নিজেদের কোনো দাবির কথা সরকারকে জানানো। এটা একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। অথচ এ মিছিলই তদানিন্তন পূর্ব বাংলার বাঙালিদের জন্য কাল হলো। তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এলেন ঢাকায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালিরা মিছিল করে তাদের ন্যায্য দাবী সরকারের প্রতি জানালো। আধুনিক গণতন্ত্রসম্মত ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পছন্দ হলো না। পাকিস্তান সরকার মিছিলকে ভয় করতো। ইয়াহিয়া খান এলেন, কিন্তু বাঙালিদের বোকা বানিয়ে গেলেন। এ যেন বানরের রুটি ভাগের কাহিনী। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে ক্ষমতার রুটির ভাগ। এর ষোলআনাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষে রাখতে মূলত: ইয়াহিয়া সেদিন ঢাকায় এসেছিলেন। পশ্চিমা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে গোপন বৈঠক করে ঘোষণা দিলেন নিরীহ বাঙালিদের নিধন করো, লুট করো, ধর্ষণ করো। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রেসিডেন্টের এ ঘোষণায় মহা খুশী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মনে করে বাঙালি রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী এরা সবাই বুদ্ধু ও বেয়াদব। 

২৫ মার্চের কালো রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর অতির্কিত ঝাপিয়ে পড়ে পাক সেনারা। ভারি মেশিনগান আর গোলা বারুদ দিয়ে মারছে বাঙালিদের। প্রলয় গর্জন, গুলি গোলার শব্দ, মানুষের আর্ত চিৎকারে সেদিন ঘুম ভেঙ্গেছিল সবার। যে যেভাবে পারে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলো তখন। পাক সেনারা রাইফেলের গুলিতে ঝাঝড়া করে দিয়েছিল অসংখ্য মায়ের বুকের ধন, যুবক, জায়া-জননী, বৃদ্ধ-বণিতাদের। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসা পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাত থেকে পূর্ব বাংলার জাত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র কেউ বাদ যায়নি। বাঙালিদের মনে সবচেয়ে বিভীষিকাময় মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ও তৎপরবর্তী নয়মাসের ক্রমান্বয় গণহত্যা, ধর্ষণ আর লুটতরাজ। পূর্ব বাঙলার মানুষের উপর যুগসন্ধিক্ষণের নারকীয় দুর্যোগ ছিল এ সময়কাল। 

বর্বর পাক সেনারা জঘন্যতম রণকৌশল সাজিয়ে নিরপরাধ বাঙালিদের হত্যা করেছিল। বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল। বাড়ি থেকে লোকজন বাইরে বেরিয়ে এলেই, কারফিউ ভঙ্গের অভিযোগ তুলে তাদের গুলি করে হত্যা করতো। নিরীহ সাধারণ বাঙালি যুবকদের চোখ বেঁধে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে বড় বড় হাট বাজারে ঢুকিয়ে দিয়ে লুটতরাজ চালাতো আর সে দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে লুটেরা বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সেনাদের বিশেষ অভিযান হিসেবে বিশ^ মিডিয়ায় তা প্রচারণা চালিয়ে এ গণহত্যাকে জায়েজ করতো। ক্যামেরায় ছবি ধারণ শেষে লুটের মালামালগুলো তাদের আর্মি জীপ ও ওয়াগনে তুলে নিতো। অবশেষে সকল বাঙালি যুবকদের একসাথে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করতো। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য বিশ^বাসী আর দেখলোও না জানলোও না। অশিক্ষিত, বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের মনে কোন মায়া-দয়া বলতে গেলে ছিল না। তাদের কাছে বাঙালিরা ছিল তখন কাফের। কাফের নিধন করা তাদের কাছে ছিল হালাল। তাই এ যুক্তিতেই নির্বিচারে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করাকে হালাল মনে করতো তারা। পূর্ব বাংলাকে দ্বিতীয় ইন্দোনেশিয়া বানাতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা। তারা চার শ্রেণির মানুষ পুর্ব বাংলা থেকে বিতাড়িত করার ফন্দি আটে- এক. বুদ্ধিজীবী, দুই. আওয়ামী লীগার, তিন. কমিউনিস্ট আর চার. হিন্দু। মূলত: পূর্ব বাংলার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী আর হিন্দু নিধন করাই ছিল তাদের মূল টার্গেট। তাদের ধারণা দেশের লাভ-ক্ষতির হিসাব সবচেয়ে ভালো জানে রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধিজীবীরা। আর এ বর্বর পাক সেনাদের নরহত্যা যজ্ঞের কাজকে আরও সুনিপুণতা আনয়ন করেছিল এদেশেরই ধর্মের লেবাসধারী বাঙালি রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ খেতাবধারী কুলাঙ্গাররা। চরিত্রহীন, শয়তান, বদমায়েশ ও অতি ধরুন্ধর বাঙালি ছিল এ গোত্রে। এ শ্রেণি সংখ্যায় নগণ্য হলেও পাক হানাদার সেনাদের পথ দেখিয়ে মুক্তিকামী মানুষকে নির্যাতন, হত্যা, লুট, ধর্ষণ অবলিলাক্রমে চালিয়েছিল তারা। 

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালির শহীদ আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে উচ্চ শিখরে স্থান করে দিয়েছে। তদানিন্তন পাকিস্তানি শাসক পুষ্ট হানাদার বাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলার বাঙ্গালিদের উপর যে নারকীয় বীভৎস গণহত্যা, লুটতরাজ ও ধর্ষণের নজির স্থাপন করেছিল জাতি তা ঘৃণার সাথে স্মরণে রাখবে। 

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –